
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ জনে। গুরুতর আহত ও দগ্ধ হয়েছেন আরও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্কুলকর্মী। বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই মডেলের একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান, যার পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
ঘটনাটি ঘটে সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে, যখন নিয়মমাফিক ক্লাস চলছিল মাইলস্টোন স্কুলের মূল একাডেমিক ভবনে। হঠাৎ করে কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমানটি বিকট শব্দে ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। বিমানটির জ্বালানি ট্যাংক বিস্ফোরিত হয়ে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। আগুনে দ্বিতীয় তলাও দগ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি হয় দাহ্য পরিস্থিতির। আতঙ্কিত হয়ে ছুটতে থাকেন শিক্ষার্থীরা, শিক্ষক ও স্কুল স্টাফরা। মুহূর্তেই শিক্ষাঙ্গন রূপ নেয় মৃত্যুকূপে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানায়, উড্ডয়নের পরপরই বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। দুর্ঘটনা এড়াতে পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর জনবহুল অঞ্চল এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা স্থানে জরুরি অবতরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। দ্রুতগতির এই যুদ্ধবিমানটি সরাসরি উত্তরার একটি স্কুল ভবনের ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ে এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পরিণত হয় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে।
যে ভবনটিতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেটি ছিল স্কুলের মূল দোতলা ভবন। ঘটনাস্থলে সরাসরি আঘাত পেয়ে জ্বালানি ট্যাংক বিস্ফোরিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে যায় আশপাশে। ক্লাসে থাকা বহু শিক্ষার্থী বিস্ফোরণে আহত হন, কেউ কেউ আটকে পড়েন ধ্বংসস্তূপের নিচে। ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, হেলিকপ্টার ও অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে শুরু হয় বিশাল উদ্ধার অভিযান। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একের পর এক মৃত্যু ঘটে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কয়েকজন শিক্ষার্থী ৯০ শতাংশের বেশি দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও এদের অনেককে বাঁচানো যায়নি। বিকেল গড়াতেই মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর মঙ্গলবার (২২ জুলাই) ভোর নাগাদ সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ জনে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় যে বিকট শব্দ শোনা যায়, তা যেন ভূমিকম্প বা বোমা বিস্ফোরণের মতো। কিছু সময় পর্যন্ত কেউ সাহস করে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি, কারণ তখনও আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। যারা নিরাপদে বের হতে পেরেছিলেন, তারা আশপাশের মানুষকে ছুটে গিয়ে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানান। ফায়ার সার্ভিস, র্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা একযোগে উদ্ধার কাজে অংশ নেন।
ঘটনার ভয়াবহতা বিবেচনা করে মঙ্গলবার সরকারিভাবে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে সরকারি অফিসে। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ইতিমধ্যে আটজনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া চলছে। কিছু মরদেহ এমনভাবে দগ্ধ হয়েছে যে তা শনাক্তে ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন পড়বে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
এই দুর্ঘটনার পর আবারও প্রশ্ন উঠেছে যুদ্ধবিমান এফ-৭ বিজিআই-এর নিরাপত্তা নিয়ে। বিশ্বের অনেক দেশে এই মডেলের বিমান পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এই মডেলের বেশ কিছু যুদ্ধবিমান দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে। ২০১৮ ও ২০১৫ সালেও এফ-৭ বিমানের দুর্ঘটনায় পাইলট প্রাণ হারিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বিমান চলাচলে অধিকতর নজরদারি ও আপডেট প্রযুক্তি সংযোজন প্রয়োজন।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইএসপিআর নিশ্চিত করেছে, একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে।
উত্তরার এই দুর্ঘটনা শুধু একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা নয়; এটি একটি জাতিগত ক্ষতির বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন বিপর্যয় খুবই বিরল এবং মর্মান্তিক। শিক্ষার্থীদের মৃত্যু, আহতদের যন্ত্রণা এবং পরিবারের আহাজারিতে পুরো দেশ আজ স্তব্ধ। এই দুর্ঘটনা দেশের বিমান চলাচল নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনার ওপর নতুন করে আলো ফেলেছে, এবং এটি ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল, প্রযুক্তি-নির্ভর এবং পরিবেশ-সচেতন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ