
ছবি: সংগৃহীত
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ৩১ জন নিহত ও ১৬৫ জন আহত হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে, বিশেষ করে সেই দিন এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া ও তারপরে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা সমাজে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।
এর মধ্যেই আজ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, আগামী ২৪ জুলাই বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপস্থিত হয়ে এই ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সিআর আবরার।
তিনি বলেন, “পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষাটি নেওয়া হবে না। এই পরীক্ষার নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হবে নিয়মিত পরীক্ষাসূচি শেষ হওয়ার পর। আমরা শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ বুঝি এবং সে অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।”
এর আগে গত সোমবার রাতে আজকের (মঙ্গলবারের) পরীক্ষাও স্থগিত ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে গভীর রাতে এ ঘোষণা আসায় দেশের বহু শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবার সকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি জানতে পারেন। এই অব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ জন্ম নেয়।
সকাল থেকেই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভে বসে। এর মধ্যে ছিল—
১. নিহতদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা প্রকাশ,
২. আহতদের নির্ভুল তালিকা ও অবস্থান,
৩. ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষক বা কর্মকর্তার দ্বারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো অসদাচরণ হয়ে থাকলে তার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা,
৪. নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান,
৫. ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বাতিল এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতির সংস্কার,
৬. ভবিষ্যতে জনবহুল এলাকায় এমন অনুশীলন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নিশ্চয়তা।
এই দাবি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে সচেতন অভিভাবক, শিক্ষক, সাধারণ নাগরিকসহ অনেকে এই দাবিগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের ছয়টি দাবির প্রতিটিকে “পূর্ণ যৌক্তিক” বিবেচনা করছে সরকার। একইসঙ্গে বলা হয়, এই দাবিগুলোর বাস্তবায়নে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার দুপুরে আন্দোলনস্থলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সিআর আবরার, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
আইন উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “শুধু আজকের দাবি মানা নয়, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নিরাপত্তা ও মানবিক সুরক্ষার নীতিমালাও প্রণয়ন করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিমান বাহিনীকে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো থেকে বিরত থাকতে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ প্লেন বাতিল এবং পুরো প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পুনঃমূল্যায়নের কাজ চলছে।”
শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরার জানান, “মাইলস্টোন স্কুলে একটি কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে নিহত ও আহতদের নাম, ঠিকানা এবং অবস্থান নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। যদি কেউ এখনো নিখোঁজ থাকে, তার তথ্যও সেখান থেকে জানা যাবে।”
তিনি বলেন, “নিহতদের পরিবারকে দ্রুততম সময়ে ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহতদের চিকিৎসা সহায়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা ব্যবস্থাপনা সাপোর্ট নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
এদিন আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অভিযোগ করে যে, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য কর্তব্য পালনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর মারধর করেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, “এই বিষয়ে সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে এবং তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।”
আইন উপদেষ্টা বলেন, “এই সরকার কারো দায় এড়িয়ে যাবে না। যে কোনো পক্ষের দায় নিরপেক্ষ তদন্তে উঠে আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সরকার দাবি মেনে নেওয়ার কথা বললেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাদের মতে, কেবল আশ্বাসে নয়, বাস্তবায়ন দেখতে চায় তারা। এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা কবরস্থানের জায়গা পেয়েছি, পরীক্ষাও স্থগিত হয়েছে, কিন্তু এতেই থেমে গেলে চলবে না। আমাদের ভাইবোনের মৃত্যু যেন শুধু পরিসংখ্যান না হয়ে থাকে।”
এইচএসসি পরীক্ষার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের সময়সূচি হঠাৎ করে পাল্টে দেওয়া, আবার পরপর দুইদিন পরীক্ষার স্থগিতাদেশ—এটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাবের প্রতিফলনও বটে।
তবে জনগণের চাপ ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে সরকার যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে তরুণদের দাবিকে “যৌক্তিক” বলে সরকার স্বীকার করে নেওয়াটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। এখন দেখার বিষয়—এই প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন কতটা সুনির্দিষ্টভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে করা যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ