
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রীয় শোক দিবসের দিন ‘এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া’ নিয়ে সৃষ্টি হওয়া বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে তার পদ থেকে প্রত্যাহার করেছে সরকার। গত বছরের ১৪ অক্টোবর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তা মাত্র নয় মাসেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দায়িত্ব হারালেন।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকেলে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা এবং জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব মাহফুজ আলম। তিনি নিজের ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।” যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়নি, তবে একাধিক প্রশাসনিক সূত্রও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সোমবার (২১ জুলাই) ঢাকার উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত একটি অনুশীলন চলাকালীন বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষকের মৃত্যু হয়। ওই দুর্ঘটনায় সারাদেশে শোকের আবহ তৈরি হলেও পরদিন (২২ জুলাই) পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকেই শত শত শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সচিবালয়ের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন। প্রথমে তারা শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে শিক্ষা সচিব ও উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করতে থাকেন। পরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তারা সচিবালয়ের মূল ফটকের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং কিছু দপ্তরের কাচ ভাঙচুর করেন। ভাঙচুরের এক পর্যায়ে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন।
সিদ্দিক জোবায়ের ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বে। পরীক্ষার সময়সূচি, ছুটি ঘোষণা, বিশেষ পরিস্থিতিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই ছিল মুখ্য। তাই রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা ও দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেওয়ায় তাকে দায়ী করেন অনেক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষানীতির বিশ্লেষক।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের প্রধান দাবি ছিল—সচিব এবং উপদেষ্টা পদে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপসারণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ছিল, “একটি দুর্ঘটনায় এতগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়া এবং দোটানায় ফেলে দেওয়া চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।”
অবশেষে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসে জোবায়েরকে প্রত্যাহার করার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, “এমন স্পর্শকাতর সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ উপেক্ষা করার পরিণাম হিসেবেই সরকার দ্রুততার সঙ্গে তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।”
২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর সিনিয়র সচিব হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন সিদ্দিক জোবায়ের। তিনি অবসরোত্তর সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। তার নিয়োগকে ঘিরেও সে সময় কিছুটা বিতর্ক ছিল, কারণ বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা সেই পদে বিবেচিত হয়েও বাদ পড়েন। তার প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও, মানবিক সংকটমুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়াই শেষ পর্যন্ত তার চাকরির মেয়াদ হ্রাসের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সচিব প্রত্যাহারের এই ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের অনেকেই আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তারা স্পষ্ট করে দেয়—পরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারকে আরও মানবিক ও সময়োপযোগী হতে হবে। অনেক অভিভাবকও বলেন, “এই পদক্ষেপ একটি বড় বার্তা দিল—জনগণের চাপ ও যৌক্তিক ক্ষোভ অগ্রাহ্য করে সরকারি কর্মকর্তা টিকে থাকতে পারেন না।”
এদিকে নতুন সিনিয়র সচিব কে হবেন, সে বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কিছু জানানো হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য থেকেই কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিমান দুর্ঘটনা ও শোক দিবসে পরীক্ষার মতো সংবেদনশীল বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায়ে সিনিয়র সচিব জোবায়েরের প্রত্যাহার সরকারে জবাবদিহিতার এক নজির হয়ে থাকল। একইসঙ্গে এটি প্রমাণ করল—সুশাসনের চাহিদা ও শিক্ষার্থীদের সংবেদনশীল দাবিকে আর উপেক্ষা করা যাবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ