
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়েছে। সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫, দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং আহত হয়েছেন প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, উদ্ধারকর্মী এবং সাধারণ মানুষ রয়েছেন।
ভয়াবহ মুহূর্তে স্কুল প্রাঙ্গণে নেমে এলো বিভীষিকা
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি অংশে বিমানটি আছড়ে পড়ার মুহূর্তে ভবনটিতে কয়েক শ' শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার সময় ক্লাস চলছিল এবং অনেকে স্কুলের প্রাঙ্গণে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, প্রথমে যুদ্ধবিমানটির একটি অংশ ধোঁয়া ছড়িয়ে আকাশে ওড়ার সময়ই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। মুহূর্তেই সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভবনের উপর ধ্বসে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়।
নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২, আহত দেড় শতাধিক
প্রাথমিক পর্যায়ে একজন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার খবর মিললেও বিকেলের দিকে মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিস, আইএসপিআর এবং স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া এবং আঘাতজনিত জটিলতা রয়েছে।
নিহতদের মধ্যে এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরও রয়েছেন। তিনি যুদ্ধবিমানটি নিয়ে বেস থেকে উড্ডয়ন করেছিলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হন বলে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
দুর্ঘটনার কারণ: যান্ত্রিক ত্রুটি
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, যুদ্ধবিমানটি রুটিন প্রশিক্ষণ মিশনের অংশ হিসেবে উড্ডয়ন করেছিল। কিন্তু উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি যান্ত্রিক সমস্যায় পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হয়।
উদ্ধার অভিযান: সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও বিজিবি মোতায়েন
বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান। উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত ছিলেন প্রায় ৫০০ জন সদস্য। যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ এবং আগুনে দগ্ধ ভবনের ভেতর থেকে আহতদের বের করে আনা হয়। ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতালে আহতদের ভর্তি করা হয়।
মেট্রোরেল দিয়ে আহতদের স্থানান্তর
এই দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে মেট্রোরেলের সহায়তা নেওয়া হয়। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সময় বাঁচাতে ঘটনাস্থল থেকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দ্রুত আহতদের পরিবহনের জন্য মেট্রোরেল ব্যবহার করা হয়, যা দেশে এই প্রথম।
সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ১৬ জন উদ্ধারকর্মী
উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে গিয়ে আহত হয়েছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৬ জন সদস্য। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে হেলিকপ্টার ও অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে সিএমএইচে নেওয়া হয়। বর্তমানে ৯ জন সেখানে ভর্তি আছেন।
সরকারিভাবে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন কোনো খরচ ছাড়াই তাদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়। যেসব হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ সীমিত, সেসব প্রতিষ্ঠানকে আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
নিহত শিক্ষার্থীদের পরিচয়
নিহতদের মধ্যে স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে। তারা হলো—অষ্টম শ্রেণির তানভীর আহমেদ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির জুনায়েদ হাসান। এ দুজনকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়।
রাষ্ট্রীয় শোক ও প্রধান উপদেষ্টার শোকবার্তা
এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় রাষ্ট্র একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে, যা পালিত হবে মঙ্গলবার, ২২ জুলাই। প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুহাম্মদ ইউনূস এক শোকবার্তায় বলেন, "এই দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সরকার এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং সব ধরনের সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করবে।"
হাসপাতাল এলাকায় ভিড় এড়াতে অনুরোধ
চিকিৎসাসেবা ব্যাহত না করতে এবং হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সাধারণ মানুষকে হাসপাতাল এলাকায় অহেতুক ভিড় না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় জাতি আজ শোকাহত। একটি প্রশিক্ষণ মিশনের অংশ হিসেবে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমানটি কীভাবে জনবহুল এলাকায় এমন ভয়ংকর বিপর্যয় সৃষ্টি করল—সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গোটা দেশ। তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষায় আজ কেবল একটাই প্রত্যাশা—এমন ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ