
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩১ জন, আহত হয়েছেন ১৬৫ জনের বেশি। পুরো দেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায়। বিমানবাহিনী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর হলেও, আজ (মঙ্গলবার) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি এলো দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে।
দুপুর তিনটার দিকে প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে জানানো হয়, বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের কবরস্থানের জন্য উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে থাকা কবরস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মৃতিকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখতে এই কবরস্থান ভবিষ্যতে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সোমবার (২১ জুলাই) সকাল ৯টার কিছু পর রাজধানীর উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। স্থানীয় সূত্র ও বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, প্রশিক্ষণ চলাকালীন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিদ্যালয় ভবনের পাশ ঘেঁষে একটি মাঠে আছড়ে পড়ে এবং সাথে সাথেই বিস্ফোরিত হয়। সেই সময় মাঠে চলছিল শারীরিক প্রশিক্ষণ ও কিছু শিক্ষার্থীর সকালের সমাবেশ। ফলে হতাহতের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল—ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা ও বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রযুক্তিগত ত্রুটির পাশাপাশি অনুশীলন ব্যবস্থায় নিরাপত্তা ঘাটতি ছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আইএসপিআর সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত মোট ৩১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং আহত হয়েছেন ১৬৫ জনের বেশি। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে। হাসপাতালে ভাগ করে দেওয়া হিসেবে আক্রান্ত ও মৃতদের পরিসংখ্যান নিচে তুলে ধরা হলো:
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল: আহত ৮, নিহত নেই
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট: আহত ৪৬, নিহত ১০
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: আহত ৩, নিহত ১
সিএমএইচ (ঢাকা সেনানিবাস): আহত ২৮, নিহত ১৬
উত্তরা লুবনা জেনারেল হাসপাতাল: আহত ১৩, নিহত ২
উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল: আহত ৬০, নিহত ১
উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল: আহত ১, নিহত নেই
শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: আহত ১, নিহত নেই
ইউনাইটেড হাসপাতাল: আহত ২, নিহত ১
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল: আহত ৩, নিহত নেই
এই হতাহতদের মধ্যে রয়েছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারী ও আশপাশের কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় বলা হয়, “আমরা নিহতদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের অঙ্গীকার করছি। তাদের জান্নাত কামনায় দেশবাসীর দোয়া চাচ্ছি। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের সিটি করপোরেশন কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে কবরস্থানের বিস্তৃতি ঘটানো হবে এবং একে পরবর্তী সময়ে স্মৃতি সংরক্ষণের স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।”
এই সিদ্ধান্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশজুড়ে সাধুবাদ পায়। নিহতদের স্বজনদের অনেকেই এই উদ্যোগে কিছুটা হলেও মানসিক প্রশান্তি পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, কবরস্থান সংরক্ষণের পাশাপাশি নিহতদের স্মৃতিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের বিষয়েও ভাবছে সরকার। এই দুর্ঘটনা শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, এটি পুরো জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এছাড়া আহত শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মানসিক সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা ও শিক্ষা পুনর্বাসনের বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করার প্রস্তুতি চলছে। একইসঙ্গে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর দুর্ঘটনার জন্য কে বা কারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল চত্বরে সংঘটিত এই বিমান দুর্ঘটনা গোটা জাতিকে নাড়া দিয়েছে। এতগুলো তরতাজা প্রাণের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে নিহতদের কবরস্থানের ব্যবস্থা, ভবিষ্যৎ সংরক্ষণ এবং তাদের স্মৃতি রক্ষার প্রতিশ্রুতি প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে মানবিক দায়িত্ববোধেরই প্রতিফলন।
তবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন, দোষীদের শাস্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া এই ক্ষতি পূরণ সম্ভব নয়—এটাই বলছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ