
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। পাশাপাশি এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৬৫ জন। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সর্বশেষ এই তথ্য প্রকাশ করে। তাদের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, রাজধানীর অন্তত ১০টি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে হতাহতদের চিকিৎসা চলছে।
এই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে। বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান রুটিন অনুশীলনের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনের পাশেই মাঠে আছড়ে পড়ে। বিস্ফোরণের ফলে ঘটনাস্থলেই বহু হতাহতের খবর আসে। দুর্ঘটনার সময় মাঠে ও ভবনে উপস্থিত ছিলেন শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারী।
আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে হতাহতদের অবস্থা বিশ্লেষণ করে নিচের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে:
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল (উত্তরা): আহত ৮ জন, নিহত নেই
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট (ঢাকা): আহত ৪৬ জন, নিহত ১০ জন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: আহত ৩ জন, নিহত ১ জন
সিএমএইচ (ঢাকা সেনানিবাস): আহত ২৮ জন, নিহত ১৬ জন
লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টার (উত্তরা): আহত ১৩ জন, নিহত ২ জন
উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল: আহত ৬০ জন, নিহত ১ জন
উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল: আহত ১ জন, নিহত নেই
শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: আহত ১ জন, নিহত নেই
ইউনাইটেড হাসপাতাল (ঢাকা): আহত ২ জন, নিহত ১ জন
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল: আহত ৩ জন, নিহত নেই
এই হিসাবে মোট আহত ১৬৫ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। আইএসপিআর জানিয়েছে, আহতদের বেশিরভাগই এখনো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন, এবং বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি প্রতিদিনের মতো নিয়মিত অনুশীলনে ছিল। সকাল থেকে কয়েকটি ফ্লাইট সফলভাবে সম্পন্ন করার পর দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে এ বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারান এবং বিমানটি নিচে নেমে আসতে শুরু করে। শেষ মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে আছড়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
স্থানীয় সময়েই ঘটনাস্থলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা চিৎকার করে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। অনেকে ভবনের ভেতরেই আটকা পড়েন। দ্রুত উদ্ধারকাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাব সদস্যরা। হেলিকপ্টারে করে আহতদের দ্রুত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
এই দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রছাত্রী ও কর্মচারী। একজন শিক্ষকও প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন শিশু, কিশোর, কলেজশিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানের সহায়ক কর্মী।
দেশজুড়ে এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস, বাতিল করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত্রিকালীন অনুষ্ঠান এবং জাতীয় কর্মসূচির একাংশ।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। নিহতদের দাফনের জন্য উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের সিটি করপোরেশন কবরস্থানে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া নিহতদের স্মৃতিতে ভবিষ্যতে ওই কবরস্থান সংরক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সিআর আবরার এবং আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মঙ্গলবার দুপুরে মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ ও ট্রমা ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যারা আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।
এই দুর্ঘটনা ঘিরে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—কেন জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান চালানো হচ্ছে? বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ নগরে বিমানবাহিনীর অনুশীলন নিরাপত্তার দিক থেকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে বিমানবাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের এই দুর্ঘটনা কেবল একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের নাগরিক নিরাপত্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামরিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার প্রতিচ্ছবি হিসেবেও দেখা হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা ৩১-এ পৌঁছানো মানে ৩১টি পরিবারে চিরন্তন শোক, অপূরণীয় ক্ষতি।
এখন সময় দ্রুত তদন্ত, দায় নিরূপণ এবং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর নীতিমালা তৈরির দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বাংলাদেশ আর কোনো পরিবারকে এমন বেদনার মুখোমুখি দেখতে চায় না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ