
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর পায়রা বন্দরের উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। দেশের নৌপরিবহন খাতের উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব নীতি অনুসরণে ‘গ্রিন পোর্ট’ হিসেবে পায়রা বন্দরকে গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বন্দরটির কার্যক্রমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করাসহ, টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশগত ঝুঁকি হ্রাস করার মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
রোববার (২০ জুলাই) পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় আয়োজিত পায়রা বন্দরের মাস্টারপ্ল্যান বিষয়ক কর্মশালায় নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম শাখাওয়াত হোসেন এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, সরকারের দৃঢ় সংকল্প পায়রা বন্দরকে পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন পোর্ট’ হিসেবে গড়ে তোলা এবং এ ক্ষেত্রে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, বর্তমান সরকারের পাশাপাশি আগামী নতুন সরকার এ কার্যক্রম আরও এগিয়ে নিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম শাখাওয়াত হোসেন ‘গ্রিন পোর্ট’ শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘গ্রিন পোর্ট’ এমন একটি বন্দর যেখানে পরিবেশের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং সেখানে পরিবেশগত টেকসই কার্যক্রমে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হয়। এই বন্দরগুলো কেবল সামুদ্রিক ও নৌপরিবহন খাতেই নয়, বরং পরিবেশগত দিক থেকে স্থিতিশীল ও দায়িত্বশীল বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। পায়রা বন্দরের ক্ষেত্রে পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে আনা, বাতাস ও জলবায়ুর দূষণ নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাই পরিকল্পনার মূল অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কর্মশালায় নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, পায়রা বন্দরের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তোলা জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা বন্দর এলাকায় উচ্চ প্রযুক্তির কার্যক্রম চালু করার পাশাপাশি পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছি। এটি বন্দরটির কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করবে।’
তিনি আরো বলেন, পায়রা বন্দরের সঙ্গে রেলপথ সংযোগ করলে বন্দরটির কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। রেললাইনের সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে ও সময় সাশ্রয় হবে। তাছাড়া বরিশালে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যা বন্দরটির মালামাল হস্তান্তরে সহায়তা করবে এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল করবে।
উপদেষ্টা এম শাখাওয়াত হোসেন জানান, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সহযোগিতায় পায়রা বন্দরে দুটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও বর্তমানে সেসব প্রকল্প স্থগিত রয়েছে, তবে ভবিষ্যতে এগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়িতে আন্তর্জাতিক মানের গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, পায়রা বন্দরের ড্রেজিং কার্যক্রম ত্বরান্বিতকরণ এবং মংলা বন্দরের মাধ্যমে রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানির উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কর্মশালায় পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাসুদ ইকবাল বলেন, ‘২০২৬ সালের জুলাই মাস থেকে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনালে পূর্ণাঙ্গ অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে।’ তিনি জানান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ দল এবং নেদারল্যান্ডসের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হাসকোনিং দীর্ঘদিন ধরে পায়রা বন্দরের জন্য একটি ব্যাপক মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছে, যা বন্দরের উন্নয়নে দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হাসকোনিং-এর দলনেতা মেনো মুইজ বলেন, ‘পায়রা বন্দরকে ঘিরে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, যা বন্দরের পরিকাঠামো ও পরিবেশগত দিক থেকে উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।’ তিনি আরও জানান, ‘মংলা বন্দরের তুলনায় পায়রা বন্দরের সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং এটি অর্থনৈতিকভাবে বৃহৎ অগ্রগতি সাধনে সক্ষম।’
পায়রা বন্দরের আধুনিকায়ন ও ‘গ্রিন পোর্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাসের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব হবে।
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও নৌপথে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। পরিবেশের প্রতি যত্নসহকারে পরিচালিত এই বন্দর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরিবেশবান্ধব বন্দর হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বর্তমান সরকারের অন্তরায়-মুক্ত উন্নয়ন নীতির অংশ হিসেবে পায়রা বন্দরের পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়িত হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ, আধুনিক পরিকাঠামো নির্মাণ, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নের এই সব উপাদান একসঙ্গে বাস্তবায়িত হলে পায়রা বন্দর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আর তা বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে একটি আধুনিক ও টেকসই নৌপরিবহন ব্যবস্থার দিশারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ