
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ ছয় বছর ধরে বাংলাদেশে আয়কর রিটার্ন জমা দেননি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি, যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি এবং সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। শুধু রিটার্ন দাখিল না করাই নয়, তার আয়কর নথিতে একাধিক অসঙ্গতি ও সম্পদ গোপনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব অভিযোগ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ জালিয়াতি চক্রের আলামত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শুধু আয়কর নয়, রাজউকের গুলশান প্লট, ফ্ল্যাট দখল এবং তা হেবা করার নাটকীয় প্রক্রিয়া, স্বর্ণ ও আয়ের তথ্য গোপন এবং জমি রেজিস্ট্রেশনে জাল হেবা দলিল পেশ করার মতো গুরুতর অপরাধের জড়িত থাকার প্রমাণও দুদক ইতিমধ্যে পেয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞ ও কর প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অভিযোগ শুধু করফাঁকি নয়—রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বড় উদাহরণ।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, টিউলিপ সিদ্দিক সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন জমা দেন। এরপর থেকে তিনি ছয় বছর ধরে কোনো রিটার্ন দাখিল করেননি। কিন্তু এরই মধ্যে তার আয়, সম্পদ ও স্বর্ণের পরিমাণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
২০০২ সালে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট (সাব-রেজিস্ট্রি দলিল নং ১৪০৭১) তার মালিকানায় এলেও, তিনি ওই ফ্ল্যাটটি দীর্ঘদিন আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেননি। বরং প্রতিটি রিটার্নে দেখিয়েছেন, “অ্যাডভান্স টুওয়ার্ডস ডেভেলপারস” খাতে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছেন, যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।
আরও চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, টিউলিপ দাবি করেছেন তিনি ওই ফ্ল্যাটটি তার ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীকে হেবা দিয়েছেন ২০১৫ সালে। এর স্বপক্ষে তিনি একটি নোটারি পাবলিকের প্রত্যয়ন সংযুক্ত করেন, যেখানে স্বাক্ষর রয়েছে অ্যাডভোকেট গাজী সিরাজুল ইসলামের। কিন্তু এই আইনজীবী দুদককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, “ওই স্বাক্ষর আমার নয়। আমি ২০১২ সালে নোটারি হিসেবে রেজিস্ট্রেশন পেয়েছি এবং কোনো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ ধরনের সেবা দিই না।”
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান বলেন, “নোটারি দলিল দিয়ে বাংলাদেশে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বৈধ নয়। এটি জালিয়াতি হিসেবে গণ্য হবে। তার ফ্ল্যাটের মালিকানা এবং হেবা দলিল দুইটাই এখন সন্দেহের তালিকায়।”
দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, টিউলিপ সিদ্দিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো টাকা পরিশোধ না করেই ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের গুলশানের একটি বহুল মূল্যবান ফ্ল্যাট দখল করে নেন। তার সঙ্গে অভিযুক্ত হয়েছেন রাজউকের দুই সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা—শাহ মো. খসরুজ্জামান ও সরদার মোশারফ হোসেন।
এই ফ্ল্যাটের বর্তমান ঠিকানা ১১৩, রোড নং ৭১, প্লট ১১বি হলেও পুরোনো ঠিকানা ছিল বি/২০১, বাড়ি ৫এ ও ৫বি। ফ্ল্যাটটি বরাদ্দ পাওয়া এবং ভোগদখল গ্রহণের ঘটনায় রয়েছে একাধিক অনিয়ম ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ।
রাজউক সংশ্লিষ্ট এক সাবেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই বরাদ্দ ও হস্তান্তরের সময় প্রচলিত আইন অনুসরণ করা হয়নি। কোনো টেন্ডার হয়নি, দামের হিসাব নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া একে কিছু বলা যাবে না।”
দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, টিউলিপ আয়কর রিটার্নে সম্পদ বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। যেমন, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তিনি ১০ ভরি স্বর্ণ দেখিয়ে দাম দেখিয়েছেন এক লাখ টাকা। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে স্বর্ণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখান ৩০ ভরি, অথচ সেই দাম একই থাকে।
এছাড়া বিভিন্ন করবর্ষে ব্যবসা থেকে নিট আয় দেখিয়েছেন ১.৬ লাখ থেকে ৩.৮৫ লাখ টাকা পর্যন্ত, কিন্তু এগুলোর উৎস, হিসাব এবং উপযুক্ত নথি নেই। আবার ২০১৩-১৪ করবর্ষে তিনি একটি মৎস্য খামার থেকে ৯ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন, অথচ কোনো জায়গায় সেই খামারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কর প্রশাসনের সাবেক সদস্য আবুল কাসেম বলেন, “একজন এমপির পক্ষ থেকে এই ধরনের কর নথি অত্যন্ত দুর্বল, বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এখানেই প্রমাণ হয় সম্পদ লুকানোর চেষ্টা ছিল।”
গত ১৫ এপ্রিল টিউলিপ ও রাজউকের দুই সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। পরে সহ-আসামি শাহ খসরুজ্জামান হাইকোর্টে মামলা স্থগিত চেয়ে আবেদন করেন। ৮ জুলাই হাইকোর্ট তার আবেদনে আংশিক রুল ও কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। তবে টিউলিপ ও মোশারফ হোসেনের ক্ষেত্রে মামলা চলমান।
দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, “হাইকোর্টে যিনি স্থগিতাদেশ পেয়েছেন, কেবল তার ক্ষেত্রেই কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। বাকি দুজনের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।” তিনি আরও জানান, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।
গত ১৩ এপ্রিল পূর্বাচলে ৩০ কাঠা জমি বরাদ্দে অনিয়ম এবং ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, রাদওয়ান মুজিব, টিউলিপ এবং রূপন্তীসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভারতে পাড়ি জমান। টিউলিপ থাকেন যুক্তরাজ্যে, যেখানে তিনি লেবার পার্টির প্রভাবশালী সদস্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “অভিযোগগুলো যেহেতু কর নথি ও প্রামাণ্য কাগজের ভিত্তিতে, তাই বিচার ব্যবস্থার আন্তর্জাতিক স্তরে এ নিয়ে জবাবদিহি সৃষ্টি হবে।”
দুদক বলছে, টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু করফাঁকি নয়—এটি অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ সংশ্লিষ্ট জালিয়াতির একটি জটিল নেটওয়ার্কের অংশ। মামলার অগ্রগতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশের কর প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা আরও প্রশ্নের মুখে পড়বে।
সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুল ইসলাম বলেন, “এটি কোনো সাধারণ মামলার বিষয় নয়। এটি প্রতীকী মামলা—যেখানে ক্ষমতাধর পরিবারের সদস্য, বিদেশি এমপি, বাংলাদেশি সম্পদ এবং রাষ্ট্রের সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান—সব জড়িয়ে গেছে। এখানে নজির স্থাপন জরুরি।”
বিশ্লেষকদের মতে, টিউলিপের বিষয়টি এখন শুধুই একটি জাল রিটার্ন বা হেবা দলিলের অনিয়ম নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক ধরনের জাতীয় স্বার্থসংক্রান্ত তদন্ত, যার ফলাফল প্রভাব ফেলবে রাজনীতি, প্রশাসন এবং জনগণের আস্থায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ