
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং জাতির এই শোকাবহ মুহূর্তে সংহতি প্রকাশে আজ মঙ্গলবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। নিহতদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী এবং এ ঘটনায় গোটা জাতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন এ দুর্ঘটনাকে জাতীয় ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচনা করে শোক পালন ও প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছে।
পতাকা অর্ধনমিত, স্থগিত জাতীয় কর্মসূচি
সোমবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক ঘোষণায় রাষ্ট্রীয় শোক পালনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। এতে বলা হয়, এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক উপলক্ষে আজ সারাদেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনেও পতাকা অর্ধনমিত রাখা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, আজকের দিনটিকে কেন্দ্র করে সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পূর্বনির্ধারিত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, যা মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অনুষ্ঠানটি এখন স্থগিত করে আগামীকাল (বুধবার) একই সময়ে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শোকবার্তা
রাষ্ট্রীয় শোকের অংশ হিসেবে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তথ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান। পাশাপাশি আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক শোকবার্তায় জানান, “বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক-কর্মচারী এবং বিমানসেনা যেভাবে হতাহত হয়েছেন, তা একটি জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। জাতি আজ গভীর বেদনার মুহূর্তে রয়েছে।” তিনি সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন।
প্রধান বিচারপতি ও উপদেষ্টাদের শোক
জাতীয় এ শোকাবহ ঘটনার পরপরই শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একই সঙ্গে সরকারের অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার বিভিন্ন উপদেষ্টা—আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় সবাই গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ তাঁর শোকবার্তায় বলেন, “শিশুদের জন্য স্কুল নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়া উচিত। এ ধরনের দুর্ঘটনা শুধু হৃদয় বিদারক নয়, ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেতও বটে।”
সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থদের প্রতিক্রিয়া
এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দীক ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেছেন এবং শোক জানিয়েছেন। তারা এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের আশ্বাস দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া: দলমত নির্বিশেষে শোক
এই মর্মান্তিক ঘটনায় দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল শোক প্রকাশ করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি রেজাউল করীম, জাতীয় পার্টি, সিপিবি, জাসদ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে।
এনসিপি আজকের জুলাই পদযাত্রা স্থগিত করেছে। পাশাপাশি সোমবার রাতে যাত্রাবাড়ীতে অনুষ্ঠিতব্য ড্রোন শোও বাতিল করা হয়।
সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনের শোক
শোক জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ সংগঠনগুলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), রাজউক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্রাব), ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ), বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশন, বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসপিএ) এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ বহু সংগঠন একযোগে শোকপ্রকাশ করেছে।
বিশেষ প্রার্থনা ও দোয়া মাহফিল
শোক দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার সারাদেশের সব উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিহতদের আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হবে।
বিশেষ করে আজ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দুপুরের নামাজের পর বিশাল আকারে দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের প্রতিটি মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় ধর্মীয় রীতিতে নিহতদের জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হচ্ছে।
জাতির জন্য দুঃখভারাক্রান্ত দিন
উত্তরার দিয়াবাড়ীতে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় একদিনে এত শিশু, অভিভাবক, শিক্ষক ও নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু গোটা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এ যেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ট্র্যাজেডি, যা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের মধ্য দিয়ে জাতি আজ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে—যারা হয়ত আর কোনোদিন স্কুলের বারান্দায় ফিরবে না।
এই শোক শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়—এই শোক সারাদেশের। প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি শিশুর মুখে আজ একটাই প্রশ্ন—“স্কুলে গিয়ে কেন আর ফেরা হলো না?” সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এখন জাতি দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দ শ্রদ্ধায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ