
ছবি: সংগৃহীত
সোমবার ঢাকায় ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-সেভেন বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দুর্ঘটনাটিতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অনেকে। মর্মান্তিক এই ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে বহুল ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান এফ-সেভেন বিজিআই—যার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে বহু দিন ধরেই বিভিন্ন দেশে প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশে এফ-সেভেন বিজিআই প্রথম যুক্ত হয় ২০১৩ সালে। সেই সময় চীনের কাছ থেকে ক্রয় করা এই যুদ্ধবিমানগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছিল, এগুলোতে অত্যাধুনিক অ্যাভিওনিকস, ডিজিটাল ককপিট ও দিন-রাত লড়াইয়ের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিমানটির ভিত্তি তৈরি হয়েছে ১৯৫০-এর দশকের সোভিয়েত প্রযুক্তিনির্ভর মিগ-২১ এর ওপর। অর্থাৎ এর মূল ফ্রেম ও কাঠামো সেই পুরোনো যুদ্ধনীতির উপর দাঁড়িয়ে, যেখানে গতিই ছিল প্রধান বিবেচ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ বসিয়ে একটি পুরোনো নকশার বিমানে আধুনিক যুদ্ধের সক্ষমতা আনা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে এফ-সেভেন সিরিজের বিমান দুর্ঘটনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলে একটি এফ-সেভেন-এমবি ভেঙে পড়ে, এবং ওই দুর্ঘটনায় পাইলট নিহত হন। এরপর ২০১৫ সালে বঙ্গোপসাগরে একটি এফ-সেভেন নিখোঁজ হয়। ২০১৮ সালে আবারও একটি এফ-সেভেন বিজি বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান একজন স্কোয়াড্রন লিডার।
সর্বশেষ দুর্ঘটনায় রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় প্রায় ২২ জন নিহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এটি এফ-সেভেন বিজিআই ইতিহাসে অন্যতম বড় ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এফ-সেভেন ও এর নানা সংস্করণ (বিশেষ করে জে-সেভেন) নিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। পাকিস্তানে, ২০১৫ সালে একটি এফটি-সেভেন পিজি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দেশটির প্রথম নারী ফাইটার পাইলট মারিয়াম মুখতিয়ার নিহত হন। ২০২০ সালে আরেক দুর্ঘটনায় মারা যান দুজন পাইলট ও পাঁচজন গ্রামবাসী।
চীনে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে একাধিক জে-সেভেন বিধ্বস্ত হয়েছে। একটি বিমান আবাসিক ভবনের উপর আছড়ে পড়লে সাধারণ মানুষ হতাহত হন। ২০২২ সালে হুবেই প্রদেশেও একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে, যাতে বেসামরিক লোকজন নিহত হন।
মিয়ানমারে, ২০১৮ সালে মাত্র একদিনেই দুটি এফ-সেভেন এম দুর্ঘটনায় দুজন পাইলট ও একজন সাধারণ নাগরিক মারা যান। ইরানে, ২০২২ সালে একটি এফ-সেভেন বিধ্বস্ত হয়ে দুই পাইলট নিহত হন। জিম্বাবুয়েতে ২০২৫ সালের একটি ঘটনায় জে-সেভেন আইআইএন বিধ্বস্ত হয়ে একজন পাইলট নিহত হন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এয়ার কমডোর (অব.) নাসিম রশীদ বলেন, “এফ-সেভেন এমন এক প্রযুক্তির ফ্রেমে তৈরি, যা আজকের যুগের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো নয়। গতির দিক থেকে দ্রুত হলেও, নিরাপত্তা, মাল্টিরোল সক্ষমতা ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার প্রতিরোধে এটি দুর্বল।”
এফ সেভেন-বিজিআই বিমানটি চীনের তৈরি এবং মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের রূপান্তরিত সংস্করণ। এটি বাংলাদেশ, মিয়ানমার, সুদান, নাইজার, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং উত্তর কোরিয়াসহ অন্তত আটটি দেশে ব্যবহার হচ্ছে।
এই বিমানগুলোতে গত এক দশকে অন্তত ৩০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে আন্তর্জাতিক সামরিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে জানা যায়। শুধুমাত্র মিয়ানমারে ২০২২ সালে দুটি এফ সেভেন বিমানের সংঘর্ষে দুই পাইলট নিহত হন। পাকিস্তানে ২০১৯ ও ২০২১ সালে দুটি পৃথক দুর্ঘটনায় এফ সেভেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন দেশটির পাইলটরা। জিম্বাবুয়ে ও সুদানেও এ ধরণের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমানটির ডিজাইন পুরনো, আর প্রযুক্তির দিক থেকেও এটি আধুনিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। বিশেষ করে এর নেভিগেশন, কমব্যাট রেডিনেস এবং ইঞ্জিন পারফরম্যান্স নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। অনেকেই মনে করছেন, বয়সের কারণে এর যান্ত্রিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এটি এখন আর আধুনিক যুদ্ধ পরিস্থিতির উপযোগী নয়।
চীনের সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ বরাবরই সন্দিহান। একাধিক সামরিক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, চীন অনেক সময় স্বল্প খরচে বিমান তৈরি করলেও এগুলোর স্থায়িত্ব, সেফটি প্রোটোকল এবং কমব্যাট-প্রমাণ ক্ষমতা পশ্চিমা প্রযুক্তির তুলনায় কম।
ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা জার্নাল "AeroDefence Global" এক প্রতিবেদনে বলেছে, “এফ সেভেন-বিজিআই একটি সস্তা সমাধান হলেও, এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলেছে।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও সামরিক প্রযুক্তি বিশ্লেষক ড. মুজাহিদ উল্লাহ খান বলেন, “একটি যুদ্ধবিমান শুধু দ্রুতগতির হলে চলবে না। ২০২৫ সালে এসে ডিজিটাল যুদ্ধপরিকল্পনা, উচ্চমাত্রায় সেন্সর ইন্টিগ্রেশন ও পাইলট সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে এফ-সেভেন অনেক পিছিয়ে।”
সাবেক এয়ারফোর্স অফিসার গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) মাহমুদ সালেহীন বলেন, “বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে এফ-সেভেন-এর বিকল্প নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু করা জরুরি। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি বারবার দুর্ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, এই প্ল্যাটফর্ম ঝুঁকিপূর্ণ। বিমানবাহিনীর মর্যাদা ও জননিরাপত্তা দুটোই হুমকির মুখে পড়ছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, সময় এসেছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নতুন প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার জেট (যেমন জেএফ-১৭ ব্লক ৩, গ্রিপেন, রাফালে বা সু-৩০ এর উন্নত সংস্করণ) সংগ্রহে বিনিয়োগের দিকে নজর দেওয়ার। এতে খরচ বেশি হলেও, দীর্ঘ মেয়াদে পাইলটদের জীবন রক্ষা এবং কার্যকর সামরিক সক্ষমতা অর্জন সম্ভব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনার পর একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা জরুরি, যারা শুধু দুর্ঘটনার কারণই নয়, বরং বিমানের নির্বাচন, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং অপারেশনাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশ্লেষণ করবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, সামরিক খাতে অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে নীতিনির্ধারণী পরিবর্তন আনতে হবে।
একটি যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা শুধু একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়; এটি একটি দেশের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং জনগণের আস্থার ওপর সরাসরি আঘাত হানে। এফ-সেভেন বিজিআই নিয়ে যে প্রশ্নগুলো এখন জোরেশোরে সামনে আসছে, তার উত্তর খুঁজতে হবে এখনই। নয়তো আগামী দিনে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ