
ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল ইউটিউবে প্রথম ভিডিও পোস্ট করা হয়। মাত্র ১৯ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা চিড়িয়াখানায় দাঁড়িয়ে হাতির কথা বলছিলেন। তার পর থেকে মাত্র ২০ বছরেই ইউটিউব হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, যেখানে প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন ঘণ্টার ভিডিও দেখা হয়। এখন ইউটিউবের জনপ্রিয়তা অনেক বড় বড় প্রোডাকশন হাউস ও হলিউডকেও ছাপিয়ে গেছে। এটি একাধারে বিনোদনের উৎস, তথ্যের ভান্ডার এবং কোটি কোটি মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম।
কিন্তু ইউটিউবের ঝলমলে, পেশাদার ও মুনাফা উপার্জনের মুখোমুখি চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গোপন, নিঃশব্দ জগৎ। যেখানে কোটি কোটি ভিডিও রয়েছে, যেগুলো প্রায় কেউ দেখে না এবং যেগুলো একদমই ভাইরাল হয় না। এই বাস্তবতা তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সিনিয়র গবেষক রায়ান ম্যাকগ্রাডির নেতৃত্বে একটি দল।
ইউটিউবের অদৃশ্য পরিধি: ১৮ ট্রিলিয়ন ইউআরএল ঘুরে খুঁজে পাওয়া এক সত্য
গবেষকরা একটি বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যা ইউটিউবের প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ইউআরএল র্যান্ডমভাবে অনুসন্ধান করেছে। এর মাধ্যমে তারা পেয়েছেন একটি চমকপ্রদ ছবি— ইউটিউবে অধিকাংশ ভিডিওর গড় ভিউ মাত্র ৪১। সেই সঙ্গে দেখা গেছে, মাত্র ১৩০ বা তার বেশি ভিউ পাওয়া ভিডিওগুলিই ইউটিউবের শীর্ষ ৩৩ শতাংশ কনটেন্টের মধ্যে পড়ে। অন্য অর্থে, বিপুল সংখ্যক ভিডিও রয়েছে এমন এক পরিধিতে যা প্রায় অদৃশ্য, প্রায় অবজ্ঞাত।
এই ‘অদৃশ্য’ ভিডিওগুলোয় অনেক সময় থাকে মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতি, আবেগ আর নানান জীবনের গল্প। ইউটিউবে এমন অনেক ভিডিও আছে যেগুলো কোনো ‘বড়’ দর্শকপ্রিয়তার আশায় তৈরি হয়নি; বরং শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে সংরক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল স্মৃতিগ্রন্থ: একান্ত ব্যক্তিগত ভিডিওর ভাণ্ডার
গবেষক ইথান জাকারম্যান বলেন, ‘সব সময় ভাবার দরকার নেই কেউ ইউটিউবে কিছু আপলোড করছে ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার জন্য। অনেকেই এখানে কেবল একটি ভিডিও সংরক্ষণ করার জন্য ভিডিও আপলোড করে। ইউটিউব এখন এক অর্থে ইন্টারনেটের ভিডিও ক্লাউড।’
এই গোপন ভাণ্ডারে রয়েছে নানা ধরনের ভিডিও—কেউ নিজের সন্তানের জন্মদিনের মুহূর্ত ধরে রেখেছে, কেউ পোষা প্রাণীর শেষ দিনগুলোর ভিডিও আপলোড করেছে, আবার কেউ রান্না করতে করতে নিজের কথা বলছেন ক্যামেরার সামনে। এসব ভিডিও মূলত ‘বন্ধু ও পরিবারের’ জন্য তৈরি, অর্থাৎ পাবলিক দেখার জন্য নয়।
গবেষণায় জানা যায়, ইউটিউবের ৭০ শতাংশের বেশি ভিডিও ইংরেজি ভাষার বাইরে অন্য ভাষায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেকে এই প্ল্যাটফর্মে ভিডিও তৈরি করেন যা বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের কাছে শেয়ার করার জন্য।
ইউটিউবের অ্যালগরিদম বনাম বাস্তব ব্যবহার
যখন আমরা ইউটিউবের অ্যালগরিদমের কথা ভাবি, তখন সাধারণত বুঝি তারা যেসব ভিডিও প্রচার করে বা সাজেস্ট করে, সেগুলো হচ্ছে জনপ্রিয়, ঝলমলে ও স্পন্সরড কনটেন্ট। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এই জনপ্রিয় ভিডিওগুলো অনেক সময় নেতিবাচক বা বিভ্রান্তিকর বিষয়ও বহন করে থাকে—যেমন রাজনৈতিক চরমপন্থা, ভুল তথ্য বা ঘৃণাসূচক বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবে ইউটিউবের অধিকাংশ ভিডিও হয় নিরপেক্ষ, সহজ, মানবিক এবং অনেক সময় আশাব্যঞ্জক।
রায়ান ম্যাকগ্রাডি বলেন, ‘ইন্টারনেট অনেক সমস্যা তৈরি করছে, কিন্তু যখন আপনি বুঝবেন মানুষ আসলে কিভাবে এটি ব্যবহার করছে, তখন দেখতে পাবেন এটি এখনো এক নির্ভেজাল প্রকাশের জায়গা, সংযোগ ও মানবিকতার এক বড় ক্ষেত্র।’
ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও: অপ্রকাশিত ইউটিউবের গল্প
২০১১ সালে এমিলি নামের এক নারী ‘sw33t tats’ নামে একটি ভিডিও আপলোড করেন, যেখানে সে ও তার বোন একে অপরের ঠোঁটের মধ্যে মার্কার পেন দিয়ে কিছু লিখছিলেন। ভিডিওটি অস্পষ্ট এবং কী লেখা হচ্ছে বোঝা যায় না। এমিলি বলেন, ‘আমি হয়তো হার্ডড্রাইভ খালি করার জন্য ভিডিওটি আপলোড করেছিলাম। এখন ভাবলে হাসি পায় যে এটা এখনও ইউটিউবে আছে।’
অন্যদিকে, মেরিল্যান্ডের এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী গত ১৪ বছরে ২৪০০টিরও বেশি ভিডিও আপলোড করেছেন। তার ভিডিওগুলোর মধ্যে রয়েছে তার চার হুশকি কুকুরের জন্য বানানো ছোট বৈদ্যুতিক গাড়ি দিয়ে ‘আর্বান মাশিং’। তিনি জানান, ‘আমি জানি আমার ভিডিও খুব বেশি মানুষ দেখে না, তবে আমি রাখি যেন মনে থাকে আমি কী করেছি, কতটা আনন্দ পেয়েছি।’
নিঃশব্দ এই জগতের মানে ও গুরুত্ব
আমাদের পরিচিত ইউটিউব যেমন মনোযোগকামী, স্পন্সরড ভিডিও ও কনটেন্ট দিয়ে ভরা, ঠিক তেমনি রয়েছে আরেক পৃথিবী—যেখানে চুপচাপ বহু মানুষ তাদের ব্যক্তিগত স্মৃতি, ছোট ছোট মুহূর্ত ও জীবনের গল্প সংরক্ষণ করে রাখে। যদিও এসব ভিডিও কখনো ভাইরাল হয় না, তারা হয়তো হাজার হাজার দর্শক পায় না, কিন্তু এটাই প্রকৃত ইউটিউবের অন্যতম বাস্তবতা।
এই নিঃশব্দ জগত মানুষের মানবিকতা, সংযোগ এবং জীবনের নানা রঙ তুলে ধরে। এ কারণে ইউটিউব শুধু বিনোদনের জায়গা নয়, বরং কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ডিজিটাল স্মৃতিগ্রন্থ হিসেবে প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছে।
ইউটিউবের এই গোপন জগত আমাদের শেখায়, প্রযুক্তির পেছনে যে মানুষের গল্প, অনুভূতি এবং স্মৃতি লুকিয়ে আছে, সেগুলোই প্রকৃত অর্থে প্ল্যাটফর্মটিকে প্রাণবন্ত করে। ঝলমলে চেহারা ও জনপ্রিয়তার আড়ালে এই অদৃশ্য, নিঃশব্দ ভিডিওগুলোর দুনিয়া থেকেই আসল ইউটিউবের হৃদয় স্পন্দিত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ