
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অভিনয় অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নাম মোশাররফ করিম। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দা—সবখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন দর্শকের এক প্রিয় মুখ। তার অভিনীত নাটক, ধারাবাহিক ও চলচ্চিত্রগুলো দর্শককে শুধু বিনোদিতই করেনি, বরং তাদের ভাবনার খোরাকও জুগিয়েছে। এক কথায় বলা যায়, মোশাররফ করিম এখন শুধু একজন অভিনেতা নন, তিনি হয়ে উঠেছেন এক সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণা, যিনি নিজেকে বারবার নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন দর্শকের সামনে। তবে সম্প্রতি তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা অনেক ভক্তের মনে কৌতূহল ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও মাঝে মাঝে অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন এই গুণী শিল্পী।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মোশাররফ করিম বলেন, “মাঝে মাঝে মনে হয় অভিনয় ছেড়ে দেব। কিন্তু ১০-১২ দিনের বেশি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তখন বুঝি, এটা ছাড়া আমি আর কিছু করতে পারি না।” তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, অভিনয়ের প্রতি তার ভালোবাসা কোনো পেশাগত দায়বদ্ধতা নয়, বরং এক গভীর আত্মিক সংযোগ। দীর্ঘদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের গল্প বলার যে ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছেন, তা থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যে সহজ নয়, সেটাই যেন বুঝিয়ে দিলেন।
তবে অভিনয় ছাড়ার এই ভাবনার পেছনে ক্লান্তি বা হতাশা নয়, বরং এক ধরনের ‘আত্মঅন্বেষণ’ কাজ করে বলেই ধারণা করছেন অনেকে। শিল্পী হিসেবে নিজেকে ভেঙে গড়ে তোলার এই যাত্রায় মোশাররফ করিম কখনও থেমে থাকতে চান না। তাই নতুন কিছু ভাবনা, নতুন কিছু চর্চা তাকে আকর্ষণ করে।
অভিনয় ছাড়ার কথা এলেই তিনি বারবার ফিরে যান নিজের আরেকটি স্বপ্নের দিকে—সাংবাদিকতা। মোশাররফ করিম বলেন, “চাকরি করার কথা ভাবতেই পারি না। কিন্তু লেখালেখি করতে ইচ্ছে করে, সাংবাদিকতা করতেও ইচ্ছা করে।” তিনি স্পষ্টভাবে জানান, অন্য কিছু তাকে টানে না, কিন্তু সাংবাদিকতার প্রতি এক ধরনের সৃজনশীল আকর্ষণ তার মনে গেঁথে আছে বহু আগে থেকেই।
তিনি বলেন, “অনেক আগেই ভাবতাম, তারিক ভাইয়ের (তারিক আনাম খান) ইন্টারভিউ নিই। আবার হায়াত ভাইয়ের (আবুল হায়াত) দীর্ঘ ইন্টারভিউ নেওয়ার ইচ্ছাও জাগে মাঝে মাঝে।” এমন ইচ্ছা শুধু কৌতূহল থেকেই নয়, বরং মানুষের ভেতরের গভীর গল্প খুঁজে পাওয়ার একটা চেষ্টা বলেই মনে করেন তিনি।
তার চোখে সাংবাদিকতা একটি সৃজনশীল পেশা। তিনি বলেন, “সাংবাদিকতার সৃজনশীলতা হচ্ছে—একজন মানুষকে বের করে নিয়ে আসা যায়, উপলব্ধি সম্পর্কে জানা যায়। আলাপ-আলোচনা কী আসলে? আলাপ-আলোচনা হচ্ছে—আমি নিজে সমৃদ্ধ হব, সেই আলোচনা দেখে বা পড়ে অন্যরাও সমৃদ্ধ হবে, আনন্দিত হবে। নতুন দিক সম্পর্কে জানতে পারবে।” এমন দৃষ্টিভঙ্গি একজন শিল্পীর মানসিক বিশ্লেষণ ও মানবিক গভীরতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়।
সাংবাদিকতা শুধুই একটা সম্ভাব্য বিকল্প নয়, বরং এটি হতে পারে মোশাররফ করিমের পরবর্তী অধ্যায়। তিনি বলেন, “কোনো দিন অভিনয় ছেড়ে দিলে সাংবাদিকতা করতেও পারি। এই পেশাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধাও করি।” একজন অভিনেতা যখন সাংবাদিকতা নিয়ে এমন আবেগ প্রকাশ করেন, তখন বোঝা যায়, সমাজ ও মানুষের গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করার প্রবল এক আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে লুকিয়ে আছে।
অভিনয়ের প্রতি তার এই নিবেদন আর প্রতিভা তাকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরিচিত করে তুলেছে। আসছে বছর যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে অনুষ্ঠিতব্য ‘৮ম বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ডালাস ২০২৫’-এ প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে মোশাররফ করিম অভিনীত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আবর্ত–দ্য সার্কেল’। মাহমুদুল হাসান টিপুর পরিচালনায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রে তার সঙ্গে অভিনয় করেছেন তার স্ত্রী ও বরেণ্য অভিনেত্রী রেবেনা রেজা জুঁই।
এ সিনেমা শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং তার অভিনয়জীবনের আরও একটি মূল্যবান অধ্যায়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের গল্প বলার ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মোশাররফ করিম এই মাধ্যমেও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন।
মোশাররফ করিম একজন শিল্পী, যিনি শুধু অভিনয়ের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তার ভাবনার পরিধি অনেক বিস্তৃত। অভিনয়ের বাইরে তার মধ্যে সাংবাদিকতা, লেখালেখি ও আত্মবিশ্লেষণের যে গভীর আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তা একজন শিল্পীর ভেতরের বহুমাত্রিকতাকে প্রকাশ করে। অভিনয় হোক বা সাংবাদিকতা—যে পথেই তিনি হাঁটুন না কেন, তার সৃজনশীলতা ও মানবিক অনুভব আমাদের ভাবায়, আলোড়িত করে। দর্শক ও পাঠকরা আগামীতেও তার কাছ থেকে এমন সৃজনশীল চমক পাবে, সেটাই প্রত্যাশা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ