
ছবি: সংগৃহীত
আগুনের লেলিহান শিখায় গুরুতরভাবে পুড়ে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসায় ত্বক প্রতিস্থাপন বা স্কিন গ্রাফটিং হয়ে দাঁড়িয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনমুখী পদ্ধতি। ত্বকের গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত অংশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং সংক্রমণ রোধে এই পদ্ধতির ভুমিকা অপরিসীম। আগুনে পুড়ে গেলে শুধু বাহ্যিক দেহে নয়, রোগীর সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব পড়ে। ত্বক ছাড়া শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, দেহ থেকে তরল ক্ষরণ বন্ধ হয় না, আর সংক্রমণের ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের জায়গায় সুস্থ ও সুরক্ষিত ত্বক প্রতিস্থাপন না করলে রোগীর জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
ত্বক প্রতিস্থাপন বলতে বোঝানো হয় রোগীর শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক সরিয়ে ফেলা এবং সেই জায়গায় সুস্থ ত্বক স্থাপন করা। সাধারণত, রোগীর নিজের শরীর থেকে নেওয়া হয় এই ত্বক, যা ‘অটোগ্রাফট’ নামে পরিচিত। কারণ রোগীর নিজের ত্বক ব্যবহার করলে শরীর এটি প্রত্যাখ্যান করে না এবং নতুন ত্বকের সঙ্গে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত শুরু হয়।
কখনো কখনো রোগীর শরীর থেকে পর্যাপ্ত সুস্থ ত্বক পাওয়া যায় না বা বড় আকারে ক্ষতি হয়েছে, তখন সাময়িকভাবে মৃতদেহের ত্বক (ক্যাডাভেরিক স্কিন) বা পশুর ত্বক ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে যথাক্রমে ‘অ্যালোগ্রাফট’ এবং ‘জেনোগ্রাফট’ বলা হয়। যদিও এগুলো দেহে স্থায়ী স্থিতিশীলতা আনতে পারে না, কারণ শরীর সময়ের সঙ্গে এগুলো প্রত্যাখ্যান করে ফেলে। তবে, এই পদ্ধতিগুলো মূলত সাময়িক বাধা হিসেবে ব্যবহৃত হয় যতক্ষণ না রোগীর নিজের সুস্থ ত্বক দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়।
ত্বক প্রতিস্থাপন একটি সুচিন্তিত, ধাপে ধাপে সম্পাদিত চিকিৎসা প্রক্রিয়া। এতে প্রধানত কয়েকটি পর্ব থাকে:
ক্ষতিপূরণের জন্য ত্বক অপসারণ: প্রথমেই পোড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ থেকে মৃত ও নষ্ট ত্বক সাবধানে সরিয়ে ফেলা হয়। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায় এবং নতুন ত্বকের জন্য পরিচ্ছন্ন ও প্রস্তুত স্থান তৈরি হয়।
ত্বক সংগ্রহ (Harvesting): এরপর রোগীর শরীর থেকে ত্বক সংগ্রহ করা হয়, সাধারণত উরু, পিঠ বা নিতম্বের অংশ থেকে। বিশেষ যন্ত্র ‘ডার্মাটোম’ ব্যবহার করে খুব পাতলা স্তরে এই ত্বক কাটা হয়, যাতে ডোনার সাইট দ্রুত সুস্থ হয় এবং রোগীর ওপর কম ক্ষতি হয়।
ত্বক প্রস্তুতি: সংগৃহীত ত্বককে কখনও কখনও ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত আকারে কাটা হয়, যা ‘মেশ গ্রাফটিং’ নামে পরিচিত। এর ফলে ত্বক বড় এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং নতুন ত্বকের নিচ থেকে তরল নির্গমনের সুযোগ থাকে, যা গ্রাফটের সফলতা বাড়ায়।
ত্বক স্থাপন ও সুরক্ষা: প্রস্তুতকৃত ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে স্থাপন করে সেলাই বা স্টেপল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। এরপর ড্রেসিং বা পটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, যা সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং রক্তনালী গঠনে সহায়তা করে।
ত্বক প্রতিস্থাপন দুই ধরনের হয়:
-
স্প্লিট-থিকনেস গ্রাফট (Split-Thickness Graft): এতে ত্বকের উপরের স্তর (এপিডার্মিস) এবং ডার্মিসের আংশিক অংশ সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয় কারণ ডোনার সাইট দ্রুত সেরে যায় এবং এটি বড় এলাকা কভার করতে সক্ষম।
-
ফুল-থিকনেস গ্রাফট (Full-Thickness Graft): এতে ত্বকের সম্পূর্ণ স্তর সংগ্রহ করা হয়। এটি মূলত ছোট, গভীর পোড়ায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে টেকসই ও স্থিতিশীল ত্বকের প্রয়োজন হয়, যেমন জয়েন্ট এলাকায়। এই পদ্ধতিতে ডোনার সাইটে বড় ক্ষত তৈরি হয় এবং সেরে ওঠতেও বেশি সময় লাগে।
ত্বক প্রতিস্থাপনের পর রোগীকে বেশ কয়েকদিন খেয়াল রাখতে হয়। নতুন ত্বক শরীরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং রক্ত সঞ্চালন শুরু করতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগে। এই সময় সংক্রমণ, গ্রাফট প্রত্যাখ্যান, বা রক্ত জমাট বাঁধার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। সফলতার জন্য নিয়মিত চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন অপরিহার্য, বিশেষ করে যখন পোড়া স্থানের কাছাকাছি জয়েন্ট থাকে, যাতে আন্দোলনের স্বাভাবিকতা বজায় থাকে।
ত্বক প্রতিস্থাপন শুধু রোগীর শারীরিক ক্ষত সারায় না, তার মানসিক সুস্থতাও বজায় রাখে। আগুনে পুড়ে যাওয়া অনেক রোগী তাদের শারীরিক আঘাতের সঙ্গে মানসিক টানাপোড়েনেও ভুগে। স্বাভাবিক দেহরূপ ফিরে পেলে তারা আত্মবিশ্বাস ফিরে পান, সমাজের সঙ্গে পুনর্মিলনের পথ সুগম হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসার শক্তি অর্জন করেন।
আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদের জন্য ত্বক প্রতিস্থাপন চিকিৎসার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষতি মেরামত করে না, বরং তাদের নতুন জীবন দেয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অগ্রগতি আগামীর দিনের জন্য আশার আলো জ্বালায়, যা আগুনে পুড়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের জীবনে নতুন আশার সুর তোলে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ