
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একসময়কার অগ্রণী নেত্রী ও সাবেক মুখপাত্র ফাতেমা খানম লিজা অবশেষে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এটি কোনো সাধারণ বিদায় ছিল না—বরং এক আবেগঘন ও তীব্র ক্ষোভে ভরা লাইভ বার্তায় তিনি রাজনীতির অন্তরালের নিষ্ঠুর বাস্তবতা, বিশেষ করে নারী নেত্রীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত কুৎসা ও বৈষম্য তুলে ধরেছেন।
শুক্রবার (১ আগস্ট) রাতে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে সরাসরি লাইভে এসে লিজা জানান, তিনি আর রাজনীতি করবেন না। বক্তব্যের শুরুতেই তার কণ্ঠ ভার হয়ে আসে। আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার দ্বারা আর রাজনীতি করা সম্ভব নয়। আমি বোঝাতে পারব না—চট্টগ্রামে মেয়েদের নিয়ে কতটা নোংরামি করা হয়, কতটা ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়। কে করে এসব? আমাদের নিজেদের মানুষই করে।”
লাইভ বার্তায় ফাতেমা খানম লিজা সরাসরি অভিযোগ করেন, পরিকল্পিতভাবে নারী নেত্রীদের ব্যক্তিগত চরিত্র হননের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাদের ঘিরে নোংরা গল্প তৈরি করে, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করার পাঁয়তারা চলছে। তিনি বলেন, “একসময় চট্টগ্রামে অনেক মেয়ে রাজনীতিতে ছিল, আজ তারা হারিয়ে গেছে। কেউ নেই। আজ আমাকে নিয়েও শুরু হয়ে গেছে এসব বাজে বয়ান, নোংরামি।”
তিনি এও জানান, “এইসব অপপ্রচার কোনো বাইরের মানুষ করছে না। আমাদের সংগঠনের ভেতরের কিছু ভাই, বড় ভাই বলেই পরিচিত লোকজন, তারাই করছে এসব। নারীরা যেন রাজনীতিতে টিকেই না থাকতে পারে, এটাই যেন তাদের উদ্দেশ্য।”
নিজের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ব্যাখ্যায় লিজা বলেন, “চট্টগ্রামের কিছুসংখ্যক মানুষের স্বার্থ, ক্ষমতার খেলা, তাদের চাওয়া-পাওয়ার কাছে আমাদের রাজনীতি হেরে গেছে। আন্দোলনের সময় যারা ছিল, তারা আজ অনেকেই নেই। কেউ হয় নিরাশ হয়ে দূরে সরে গেছে, কেউ হয়েছে নিষ্ক্রিয়। আমি নিজেও এখন তাদের দলে।”
তার অভিযোগ, “কিছু ভাই-ব্রাদার কেন্দ্রের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চট্টগ্রামে একটার পর একটা কোরাম বানিয়েছে। কোরামের নামে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এ দায় আপনাদের নিতে হবে। কেন মেয়েরা এগিয়ে আসতে পারে না—তার উত্তর আপনাদেরই খুঁজতে হবে।”
লাইভের শেষ অংশে এসে আবেগ সংবরণ করতে পারেননি লিজা। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, “আমার দ্বারা আর সত্যিই রাজনীতি করা সম্ভব নয়। আমি এই যুদ্ধ আর চালিয়ে যেতে পারছি না। বারবার আঘাত খেতে খেতে ভেঙে পড়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “আপনারা যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করেন, প্লিজ মেয়েদের নিয়ে এই নোংরামি বন্ধ করুন। একটা মেয়ে যখন নেতৃত্বে আসে, তখন তাকে কত কষ্ট করে টিকে থাকতে হয়, সেটা আপনারা জানেন না বা জানতেও চান না।”
লিজার এই ঘোষণার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই তার সাহসী অবস্থানের প্রশংসা করেছেন, আবার কেউ কেউ কটাক্ষও করেছেন। কেউ লিখেছেন, “লিজা বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন, চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সত্যিই মেয়েদের জায়গা সংকুচিত করা হচ্ছে।” আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, “এই মুহূর্তে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা কি দায়িত্বশীল পদক্ষেপ?”
তবে অধিকাংশ মন্তব্যেই তার প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার ছাপ পাওয়া গেছে। অনেকে তাকে ‘নির্যাতিত কণ্ঠস্বর’, আবার কেউ ‘মেরুদণ্ডসম্পন্ন নেত্রী’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
লিজার এই ঘোষণা শুধুমাত্র একজন নেত্রীর বিদায় নয়; বরং তা চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অবস্থান, নিরাপত্তা ও সম্মান নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে।
এই ঘটনা একদিকে যেমন সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উন্মোচন করে, অন্যদিকে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পথে যে ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা, তাও স্পষ্ট করে তোলে।
ফাতেমা খানম লিজা হয়তো রাজনীতি থেকে সরে গেছেন, কিন্তু তার লাইভে উচ্চারিত কথা এখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে অনেককে—এই সমাজ কি আদৌ প্রস্তুত নারীর নেতৃত্ব গ্রহণে? নারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে যে রাজনীতি টিকছে, তা কতটা সুস্থ এবং কতটা টেকসই?
এ প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। তবে এখনই আলোচনায় উঠে এসেছে: "লিজার রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা কি কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, নাকি এটি নারী রাজনীতিকদের প্রতি সামাজিক সহিংসতার আরও একটি দলিল?"
বাংলাবার্তা/এমএইচ