
ছবি: সংগৃহীত
মানবদেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ ত্বক। এটি শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের বাহক নয়, বরং আমাদের দেহকে রক্ষা করে বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, কেমিক্যাল ও পরিবেশগত আক্রমণ থেকে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গেই যদি বাসা বাঁধে ক্যানসার, তাহলে তা হয়ে ওঠে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের নাম। চিকিৎসকদের মতে, সময়মতো সচেতনতা ও প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিলে ত্বকের ক্যানসারকে অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে সমস্যা হলো, আমাদের দেশে এখনো ত্বকের ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা খুবই কম।
নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আসমা তাসনীম খান জানিয়েছেন ত্বকের ক্যানসার কী, এটি কেন হয়, কীভাবে বোঝা যায় এবং কীভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ত্বকের ক্যানসার কীভাবে হয়?
চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, ত্বকের কোষ বা সেলের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির কারণেই ত্বকের ক্যানসার হয়। সাধারণভাবে, আমাদের ত্বকের কোষগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়মে বৃদ্ধি পায় এবং মারা যায়। কিন্তু কোনো কারণে যদি এই প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, অর্থাৎ কোষগুলো যদি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে তা ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।
এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি (UV rays)। যারা দীর্ঘ সময় রোদে কাজ করেন বা সূর্যের আলোতে নিয়মিত থাকেন, তাদের ত্বকের কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে ক্যানসারের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
তবে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ছাড়াও রয়েছে আরও বেশ কিছু কারণ—
-
সান ট্যান ও ট্যানিং বিছানা: অনেকে সৌন্দর্যের জন্য ত্বক ট্যান করার প্রবণতায় থাকেন। কিন্তু এই ট্যানিং প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত রশ্মিও ত্বকের ক্ষতি করে এবং ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।
-
সানস্ক্রিন ব্যবহার না করা: রোদের মধ্যে বের হলেও যদি সানস্ক্রিন ব্যবহার না করা হয়, তাহলে ত্বকের কোষ সরাসরি UV রশ্মির সংস্পর্শে আসে।
-
পারিবারিক ইতিহাস: কারো পরিবারে ত্বকের ক্যানসার থাকলে উত্তরসূরিদের মধ্যেও এর ঝুঁকি থাকে।
-
দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হলে শরীর সহজে ক্যানসারের কোষ মোকাবিলা করতে পারে না।
ত্বকের ক্যানসারের প্রকারভেদ
চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ত্বকের ক্যানসারের কয়েকটি সাধারণ ধরন রয়েছে। প্রতিটি ক্যানসারের বৈশিষ্ট্য ও বিস্তারের ধরন ভিন্ন।
১. বেসাল সেল কার্সিনোমা (Basal Cell Carcinoma)
এই ধরনের ক্যানসার ত্বকের সবচেয়ে নিচের স্তর বেসাল সেলে দেখা যায়। এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে কম ছড়ায়। সাধারণত রোদে বেশি এক্সপোজার পাওয়া অংশ— যেমন মুখ, গলা ও হাতের ওপরের অংশে দেখা যায়।
২. স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (Squamous Cell Carcinoma)
এটি ত্বকের মাঝামাঝি স্তরের স্কোয়ামাস সেলে দেখা দেয় এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। মুখ, কানে, ঠোঁটে, এমনকি হাতের পিঠে এই ক্যানসার বেশি দেখা যায়।
৩. মেলানোমা (Melanoma)
সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী ত্বকের ক্যানসার হলো মেলানোমা। এটি মেলানোসাইট নামক কোষে তৈরি হয়, যা ত্বকের রং নির্ধারণ করে। মেলানোমা শরীরের যেকোনো স্থানে তৈরি হতে পারে এবং খুব দ্রুত শরীরের অন্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৪. অন্যান্য ধরনের ক্যানসার
এর বাইরে আরও কিছু কম পরিচিত ধরনের ত্বকের ক্যানসার রয়েছে যেমন মার্কেল সেল কার্সিনোমা, ডার্মাটোফাইব্রোসারকোমা প্রোটিউবেরান্স ইত্যাদি।
লক্ষণ: কীভাবে বুঝবেন ত্বকে ক্যানসার হয়েছে?
প্রাথমিক পর্যায়ে ত্বকের ক্যানসার খুব বেশি ব্যথা বা অস্বস্তি তৈরি করে না বলেই অনেকেই বিষয়টি অবহেলা করেন। কিন্তু কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখা দিলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত—
-
ত্বকে ছোট ছোট তিল বা মোল যা হঠাৎ করে আকারে বাড়তে শুরু করে
-
তিল বা মোলের রঙের পরিবর্তন হয় বা তা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে
-
ত্বকে ঘা বা ক্ষত হয়ে যায় যা সহজে সারতে চায় না
-
কোনো তিল বা দাগ থেকে রক্তপাত, চুলকানি বা পুঁজ নিঃসরণ হয়
-
পুরনো তিল বা দাগের আশেপাশে নতুন দাগ বা গোঁড়া তৈরি হয়
চিকিৎসা: ত্বকের ক্যানসার হলে করণীয় কী?
চিকিৎসক ডা. আসমা তাসনীম খান বলেন, প্রথম ধাপ হচ্ছে রোগ নির্ণয়। ত্বকে যদি কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, তবে প্রথমে চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা করেন। সন্দেহজনক দাগ বা মোল থাকলে বায়োপসি করা হয়।
বায়োপসির রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়লে সিটি স্ক্যান, এমআরআই ও অন্যান্য পরীক্ষা করা হয় যাতে বোঝা যায় ক্যানসার কতটা বিস্তৃত হয়েছে।
চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে ক্যানসারের ধরন, স্টেজ ও রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। সাধারণত ত্বকের ক্যানসারের চিকিৎসায় নিচের পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়—
-
অস্ত্রোপচার: ক্যানসারযুক্ত টিস্যু অপসারণের জন্য অপারেশন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মোহস সার্জারি নামক বিশেষ পদ্ধতিও প্রয়োগ করা হয়, যাতে ক্যানসার কোষগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে কেটে ফেলা যায়।
-
রেডিওথেরাপি: ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে উচ্চতর রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হয়।
-
কেমোথেরাপি: ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করা হয়।
-
ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপি: শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে সক্রিয় করার চিকিৎসা।
প্রতিরোধের উপায়: কীভাবে রক্ষা করা যাবে ত্বককে?
ত্বকের ক্যানসার একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ—এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস গড়ে তুললে এবং সচেতন থাকলে এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
১. সূর্য থেকে সুরক্ষা:
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচতে বাইরে বের হলে টুপি, সানগ্লাস, ফুল হাতা জামা ব্যবহার করতে হবে।
২. সানস্ক্রিন ব্যবহার:
বাইরে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে SPF ৩০ বা তার বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে এবং প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পরপর পুনরায় প্রয়োগ করতে হবে।
৩. ট্যানিং পরিহার:
ট্যানিং বিছানা বা সূর্যের নিচে ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে ত্বক ট্যান করার অভ্যাস বাদ দিতে হবে।
৪. ত্বকে যেকোনো পরিবর্তন নজরে রাখা:
ত্বকে নতুন কোনো দাগ, তিল, ঘা কিংবা তিলের আকার বা রঙের পরিবর্তন হলে অবহেলা না করে ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
ত্বকের ক্যানসার এখন আর শুধু পশ্চিমা দেশের সমস্যা নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এটি ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এই রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে সচেতনতা। নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার, সূর্যের রশ্মি থেকে সুরক্ষা, এবং ত্বকে যেকোনো অস্বাভাবিকতা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ—এই কয়েকটি সহজ পদক্ষেপই আপনাকে ত্বকের ক্যানসার থেকে নিরাপদ রাখতে পারে।
ত্বক শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি আমাদের জীবনের বর্ম—সেই বর্মের যত্ন নেওয়া দায়িত্ব আপনার নিজের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ