
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় নিহত ১১৪ জন শহীদের পরিচয় শনাক্তে কবর থেকে মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। নিহতদের অধিকাংশই অজ্ঞাতনামা হিসেবে দাফন করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর সোমবার (৪ আগস্ট) এই সংক্রান্ত আদেশ দেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। আদালতের এই নির্দেশে নতুন করে আলোচনায় এসেছে অভ্যুত্থান চলাকালে ঘটে যাওয়া সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন ও শহীদের প্রতি ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার।
আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহিদুল ইসলাম একটি আবেদন দাখিল করেন যেখানে তিনি ১১৪ জন শহীদের মরদেহ উত্তোলনের অনুমতি চান। তিনি উল্লেখ করেন, গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বিভিন্ন বয়সের নারী ও পুরুষদের। যারা শাহাদত বরণ করেন, তাদের অনেকের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে অজ্ঞাতনামা হিসেবেই তাঁদেরকে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আবেদনে আরও বলা হয়, "ভবিষ্যতে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শহীদদের মরদেহ শনাক্তের জন্য কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন, সেগুলোর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা, ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ এবং ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা আবশ্যক। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হবে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত একটি বড় ধরনের মানবাধিকার ও বিচারিক অগ্রগতি। নিহত শহীদদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা পালনের জন্য মরদেহ শনাক্তকরণ ও স্বজনদের হাতে হস্তান্তর গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছিল যে, নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করে তাদের পরিবারকে অবহিত করতে হবে, এবং যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী ও বিশ্লেষকরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, এটি ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়কে ন্যায়বিচারের আওতায় আনার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের সময় নিহতদের অনেকেই নিখোঁজ ছিলেন, কেউ কেউ ছিল পথচারী, আবার কেউ কেউ আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। আজ অবধি তাঁদের কোনো শনাক্তকরণ বা তদন্ত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
মরদেহ উত্তোলনের পর সেগুলোর ময়নাতদন্ত এবং ফরেনসিক পরীক্ষার অংশ হিসেবে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে এসব নমুনার বিশ্লেষণ করা হবে। পরিবারের পক্ষ থেকে যারা সম্ভাব্যভাবে তাদের আত্মীয় হারিয়েছেন বলে দাবি করবেন, তাঁদের ডিএনএ নমুনা নিয়ে ম্যাচ করানো হবে। এতে করে শনাক্তকরণ সম্ভব হলে মরদেহ পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিএনএ প্রোফাইলিং একটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া হলেও এটি শহীদদের স্বীকৃতি দেওয়ার একমাত্র নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক উপায়।
ঢাকার রায়েরবাজার এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অভ্যুত্থানের সময় প্রায় প্রতিদিনই ওই এলাকায় অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ আনা হতো। সেগুলো অজ্ঞাতনামা হিসেবে দাফন করা হয়েছিল। বহু পরিবার তখন থেকেই নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অনেকে আজও জানেন না, তাঁদের প্রিয়জন বেঁচে আছেন কি না। আদালতের এই নির্দেশ তাঁদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
শহীদদের পরিবার ও স্বজনদের প্রতিনিধিরা বলছেন, মরদেহ শনাক্ত করে পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগ একটি মানবিক বিজয়। এটা শুধু মরদেহ হস্তান্তরের প্রশ্ন নয়, বরং যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপার।
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, শিগগিরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সিটি করপোরেশন, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে একটি যৌথ টিম গঠন করে কবর থেকে মরদেহ উত্তোলনের কাজ শুরু হবে। এই প্রক্রিয়া হবে ভিডিও ও ছবি ধারণসহ সব ধরনের প্রামাণ্য নথিপত্র সংগ্রহ করে। মরদেহ শনাক্তের পরে প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই নির্দেশ রাষ্ট্রের পক্ষে এক পরীক্ষাও বটে। শহীদদের মর্যাদা রক্ষা, নিরপেক্ষ তদন্ত, এবং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে এটি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
এই মামলার পরবর্তী শুনানি কবে হবে এবং শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় কত সময় লাগবে, সে বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য জানানো হয়নি। তবে আদালতের এই উদ্যোগ একটি ঐতিহাসিক দায় পূরণের পথে প্রথম দৃশ্যমান পদক্ষেপ বলেই মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ