
ছবি: সংগৃহীত
গত ১১ মাসে দেশের রাজনীতিতে সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিষ্ঠানটির এক সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়কালে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৭১টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২১ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৫ হাজার ১৮৯ জন। এই সহিংস ঘটনাগুলোর মূল পটভূমি হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রতিপক্ষ দমনে সহিংস পন্থার ব্যবহার এবং দলীয় স্বার্থে আইন অমান্য করার সংস্কৃতি দায়ী বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি।
সোমবার (৪ আগস্ট) রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত টিআইবির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘স্বৈরাচারী সরকারের পতনের এক বছর: প্রত্যাশা ও অর্জন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষক শাহজাদা আকরাম ও জুলকারনাইন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সহিংসতার ঘটনায় ৯২ শতাংশের সঙ্গে বিএনপি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার হার ২২ শতাংশ, জামায়াতের ৫ শতাংশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির ১ শতাংশ। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, একাধিক দলের সম্পৃক্ততার ফলে শতকরা হারগুলো যোগফলে ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা স্পষ্ট করে যে একাধিক পক্ষ একই ঘটনায় জড়িত ছিল।
টিআইবি আরও জানায়, এই সহিংসতাগুলো শুধু রাজনৈতিক মঞ্চেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, পরিবহন টার্মিনাল দখল এবং ব্যবসায় প্রভাব বিস্তারসহ নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল।
গবেষক জুলকারনাইন বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার অভাব, দলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা—এসব কারণে তারা বারবার সহিংসতা ও অপকর্মে জড়াচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যেও দলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এমন সব কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যা গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায়ের পরিপন্থী।”
প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা পেয়েছি। যদিও নানা সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশই ছিল অ্যাডহক, কিংবা সুস্পষ্ট রূপরেখাবিহীন। বাস্তবায়নেও ছিল ঘাটতি। ফলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি।”
তিনি আরও বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নবগঠিত একটি রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু অংশ এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মী নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বার্থের সংঘাত।”
টিআইবির মতে, সহিংসতা-ভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা, প্রশাসনিক পক্ষপাত এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতা নতুন করে গণতন্ত্রের বিকাশকে হুমকির মুখে ফেলছে। প্রতিষ্ঠানটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, একদিকে যেমন স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে, অন্যদিকে স্বৈরাচারী মানসিকতা ও কাঠামোর মূলোৎপাটন এখনো হয়নি।
গবেষণার আলোকে কয়েকটি প্রস্তাবও দিয়েছে টিআইবি। এর মধ্যে রয়েছে:
-
রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
-
অপরাধে জড়িত দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ
-
প্রশাসনে দলীয়করণের সংস্কৃতি বন্ধ করা
-
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও রূপরেখাভিত্তিক সংস্কার নিশ্চিত করা
-
সহিংসতার ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো পক্ষপাত না দেখানো
এছাড়া প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, “রাজনৈতিক সহিংসতা কেবল জননিরাপত্তা নয়, দেশের অর্থনীতি, প্রশাসনিক ভারসাম্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও বিপন্ন করছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের দায়বদ্ধতা না স্বীকার করে এবং সহিংসতাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম হতে পারে।”
সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে টিআইবির এই গবেষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি কেবল গত এক বছরের সহিংসতা বিশ্লেষণই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক বাস্তবচিত্রও তুলে ধরে।
পরিশেষে, টিআইবি বলছে—কেবল সরকার বদল নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। তা না হলে গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে অগ্রগতি সম্ভব নয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ