
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও একীভূতভাবে পরিচালনা করতে নতুন কাঠামো ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই কাঠামো অনুযায়ী সাতটি কলেজকে চারটি পৃথক স্কুল বা একাডেমিক শাখায় বিভক্ত করে পাঠদান, প্রশাসন ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এই সিদ্ধান্ত আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যকর হতে পারে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সোমবার (৪ আগস্ট) সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মজিবুর রহমান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “সরকারি সাত কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও দক্ষভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো দাঁড় করিয়েছে। এতে করে একদিকে যেমন শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের ভোগান্তিরও অবসান ঘটবে।”
চারটি স্কুলে বিভাজন: কোন কলেজ কোন স্কুলে?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, সাতটি কলেজকে চারটি একাডেমিক স্কুলের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রত্যেক স্কুলের অধীনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
১. স্কুল অব সাইন্স (School of Science):
-
ঢাকা কলেজ
-
ইডেন মহিলা কলেজ
-
বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ
এই তিনটি কলেজে বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীদের পাঠদান হবে একাডেমিক সমন্বয়ের মাধ্যমে।
২. স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ (School of Business Studies):
-
সরকারি বাঙলা কলেজ
এ কলেজে ব্যবসায় প্রশাসন সম্পর্কিত বিষয়াবলি যেমন ব্যবস্থাপনা, হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স, মার্কেটিংসহ অন্যান্য পাঠ্যক্রম পরিচালিত হবে।
৩. স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ (School of Arts and Humanities):
-
সরকারি তিতুমীর কলেজ
এই স্কুলের আওতায় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ মানবিক শাখার পাঠদান চলবে।
৪. স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিস (School of Law and Justice):
-
কবি নজরুল সরকারি কলেজ
-
শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ
আইন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালিত হবে এই দুই কলেজের মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কাঠামো: সিনেট, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত নতুন কাঠামোতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি একাডেমিক কাউন্সিল, সিনেট এবং সিন্ডিকেট গঠন করে সকল স্কুল ও কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এটি কার্যত একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর আদলে পরিচালিত হবে, যাতে করে একাডেমিক ক্যালেন্ডার, পরীক্ষার রুটিন, ফল প্রকাশ ও শিক্ষার্থী সেবা সমন্বিতভাবে পরিচালিত করা যায়।
প্রত্যেকটি স্কুলের নিজস্ব ডিন এবং সমন্বয়কারী শিক্ষকগণ থাকবে, যারা সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে পাঠদান কার্যক্রম চালাবেন। পাশাপাশি থাকবে কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদ, যা নীতিনির্ধারণী ও বাস্তবায়ন পর্যায়ের সমন্বয় করবে।
নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য প্রক্টরিয়াল টিম
প্রক্টরিয়াল নজরদারি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় একজন প্রধান প্রক্টর এবং সাতটি কলেজে ১৪ জন ডেপুটি প্রক্টর দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতিটি কলেজে দুজন করে ডেপুটি প্রক্টর দায়িত্বে থাকবেন, যারা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে শৃঙ্খলা, অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রমে সহায়তা করবেন।
দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল এই কাঠামো?
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর থেকেই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সমস্যার কারণে একাধিকবার আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। সময়মতো ক্লাস না হওয়া, পরীক্ষার তারিখ হঠাৎ বদল, ফল প্রকাশে দেরি, শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, একাডেমিক ক্যালেন্ডার না থাকা, প্রশাসনিক অস্থিরতা— এসব কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমছিল।
বিশেষ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি করে আসছিলেন, “আমরা ঢাবির অধিভুক্ত হলেও আচরণ করা হয় আলাদা প্রতিষ্ঠানের মতো।” ফলে বারবার সেশনজটে পড়তে হয়েছে তাদের। এবার কেন্দ্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে একাডেমিক কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে চালাতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, এই কেন্দ্রীয় কাঠামো বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণে একরূপতা আসবে, তেমনি শিক্ষার মানও বাড়বে। শিক্ষক, ক্লাসরুটিন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন ও ফলাফল প্রকাশ— সব কিছুতে কেন্দ্রীয় মনিটরিং থাকায় দায়িত্বহীনতা অনেকটা কমে আসবে।
তবে কেউ কেউ আশঙ্কাও করছেন, “সরকারি ঘোষণা সুন্দর, কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া জটিল। আগে যেসব ঘোষণা হয়েছিল, তা সেভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। এবারও যদি শিক্ষকের অভাব, শ্রেণিকক্ষ সংকট ও প্রশাসনিক সমন্বয় না হয়, তাহলে একই ভোগান্তি চলতে থাকবে।”
শিক্ষক সমাজের মতামত
সরকারি কলেজগুলোর অনেক শিক্ষক এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, এটি “একটি কাঠামোগত সংস্কার”, যা দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলাকে একটি সুসংগঠিত পরিসরে নিয়ে আসবে। তারা বলছেন, এর ফলে প্রতিটি কলেজ তার নিজস্ব স্কুলের অধীনে নিজস্ব বিষয়ে বিশেষায়িত পাঠদান করতে পারবে। এতে করে গবেষণাও উৎসাহিত হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই কেন্দ্রীয় কাঠামোর আওতায় ভবিষ্যতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, গবেষণা অনুদান, ডিজিটাল রেকর্ড কিপিং এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ‘একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন পোর্টাল’ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার একাডেমিক প্রগ্রেস, রেজাল্ট, পরীক্ষার সময়সূচি ও নোটিশ পেতে পারবে।
সরকারি সাত কলেজকে চারটি একাডেমিক স্কুলে ভাগ করে পাঠদান চালুর মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দীর্ঘ সময়ের অনিয়ম, প্রতিবন্ধকতা ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী। এখন প্রশ্ন হলো, কতটা দ্রুত এবং সফলভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে? শিক্ষার্থীরা তাকিয়ে আছে— আশাবাদ নিয়ে, আবার কিছুটা সংশয়ের চোখেও।
বাংলাবার্তা/এমএইচ