
ছবি: সংগৃহীত
বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত ‘জুলাই সনদ’-এ যে কোনো মুহূর্তে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত রয়েছে বিএনপি—এমনটাই জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী জ্যেষ্ঠ নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। সোমবার (৪ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, বিএনপি জুলাই সনদকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং ইতোমধ্যেই সনদের খসড়ায় প্রয়োজনীয় পর্যালোচনা ও সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা জুলাই সনদ হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ৩০ জুলাই তারিখে এর খসড়া পর্যালোচনা করে কিছু বিষয় সংশোধনপূর্বক জবাব দিয়েছি। বিএনপি চায় এই ঐতিহাসিক দলিলটি যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয় এবং দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধান পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে একটি কার্যকর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। আমরা কারও পেছনে পড়ে নেই, প্রস্তুত রয়েছি স্বাক্ষরের জন্য। এখন শুধু চূড়ান্ত সম্মতির অপেক্ষা।”
জুলাই সনদ, যেটিকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হিসেবেও অভিহিত করা হচ্ছে, মূলত ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ও নির্বাচনী রূপরেখা নিয়ে প্রস্তাবিত একটি রাজনৈতিক দলিল, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট কমিশনসমূহের অংশগ্রহণে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন জানান, সনদের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়েই ফেব্রুয়ারির দিকেই বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল। সেখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল—২৬ মার্চকে তারা এ প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করতে চান না। বিএনপি মনে করে, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনালগ্ন হলেও তা দলীয় বিবেচনায় নয়, বরং জাতির সার্বজনীন ঐতিহাসিক ঘটনা—যা এই দলিলে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য নয়।
সনদের সাংবিধানিক বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হলে তা চতুর্থ তপশিলের মাধ্যমে হতে হবে। এটি আইনগতভাবে শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতে যে কোনো সরকার বদলেও এই দলিল বহাল থাকবে।”
তবে, বিএনপি যে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে, তাও গোপন করেননি তিনি। সালাহউদ্দিন বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সংস্কার কমিশনের ১৯টি মৌলিক বিষয়ের মধ্যে আমরা ৭টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি। তবে বাকি ১২টিতে আমরা একমত। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়, আমরা গঠনমূলক আলোচনায় বিশ্বাস করি এবং ঐক্যের পক্ষে।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই সনদের পেছনে দীর্ঘ সময়, শ্রম ও আলোচনার ইতিহাস রয়েছে। এটি শুধু একটি ঘোষণাপত্র নয়, বরং গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও নির্বাচনী সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক রূপরেখা। এ দলিলের মধ্যে দিয়ে বর্তমান ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত হবে—এই বিশ্বাসেই আমরা এতে অংশ নিচ্ছি।”
এ সময় তিনি সমালোচকদের উদ্দেশে বলেন, “অনেকে বলছেন বিএনপি সনদে সই করবে না, সহযোগিতা করছে না, নিশ্চয়তা চাচ্ছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই—বিএনপি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে, করছে এবং করতে প্রস্তুত। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের যে ন্যায্য আপত্তি ও প্রস্তাব রয়েছে, তা তো তুলে ধরতেই হবে। কোনো অন্ধ আনুগত্যে নয়, যুক্তিপূর্ণ আলোচনার ভিত্তিতেই আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে চাই।”
তবে, ৫ আগস্ট মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ অনুষ্ঠানে এখনও বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলেও জানান তিনি। “আমরা এখনও দাওয়াত পাইনি, তবে আমরা প্রস্তুত। আমাদের অবস্থান ইতিবাচক ও স্পষ্ট,” বলেন সালাহউদ্দিন।
বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা সকল রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত দলগুলোকে উদ্দেশ করে আহ্বান জানান—“আমরা যারা গণতন্ত্র চাই, তাদের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। বিভাজনের কোনো সুযোগ নেই। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য আমাদের সকলের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।”
জুলাই সনদ নিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে উত্তেজনা ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায়, এই দলিল দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে শেষপর্যন্ত বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত অবস্থানই নির্ধারণ করবে—এই সনদ কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে, না কি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপে পরিণত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ