
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করবেন দেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থার প্রধান ব্যক্তি, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত এক জনসভায় বিকেল ৫টায় তিনি এ ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। অনুষ্ঠানটি রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আজ সোমবার দুপুরে এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তারা জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবেই এই ঘোষণাপত্র পাঠের আয়োজন করা হয়েছে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়—বরং নতুন রাষ্ট্রীয় রূপরেখা, গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পথচলার দিকনির্দেশনা বলেই মনে করছে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গত বছর এই সময়েই দেশে ঘটে যায় ঐতিহাসিক এক রাজনৈতিক পালাবদল। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বছরজুড়ে চলা আন্দোলনের culminate বা চূড়ান্ত রূপ নেয় জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে। তারই বার্ষিকী উপলক্ষে সরকার আগামীকাল দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—শ্রদ্ধাঞ্জলি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ।
প্রেস উইং সূত্রে জানা গেছে, ঘোষণা অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, ছাত্র ও যুব প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। মূলত যারা ২০২৪ সালের গণআন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, সেই অংশীদারদের সম্মিলনে ‘জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে’ এই ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে সরকারকে একটি জাতীয় ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি জানানো হয়। তাঁদের বক্তব্য ছিল, দেশজুড়ে সামরিকীকরণ, দলীয়করণ, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছে—তাতে নতুন এক রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রয়োজন আছে। এর জবাবে সরকার তখনই জানায়, একটি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরি হচ্ছে, যা হবে নতুন যুগের রূপরেখা।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কার্যালয় তখন থেকেই দেশের সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ চালিয়ে যায়। খসড়া প্রণয়নের এই প্রক্রিয়া চলে টানা কয়েক মাস ধরে।
বর্তমানে ঘোষণাপত্রটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে এবং এটি পাঠের মাধ্যমে আগামীকাল জাতির সামনে প্রকাশ পাবে। এতে শুধু রাজনৈতিক রূপরেখা নয়, শিক্ষানীতি, করব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থার সংস্কার, সামরিক বাহিনীর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, পরিবেশ-সংরক্ষণ এবং ডিজিটাল অর্থনীতির দিকনির্দেশনাও থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঘোষণাপত্র পাঠের সময় মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন দেশের সক্রিয় ও নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থানের সময় যারা ‘অস্থায়ী জাতীয় ঐকমত্য ফোরাম’ গঠন করেছিল—তাদের প্রত্যেককেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, সাবেক আমলারা, বিচারপতিরা এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে। এটি মূলত অভ্যন্তরীণ একটি রূপরেখা হলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের একটি বার্তাও পাঠাবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
সরকারি সূত্র বলছে, ঘোষণাপত্রটি হবে আগামী নির্বাচন, সাংবিধানিক সংস্কার ও জাতীয় সরকার গঠনের দিকনির্দেশনা। এতে থাকবে মানবাধিকার, গণমাধ্যম স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি।
এর আগে এমন একটি ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র পাঠ হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, যখন গঠিত হয়েছিল মুজিবনগর সরকার। এবার ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকেই নতুন করে রূপ দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান উপদেষ্টা সরকার যেভাবে ধাপে ধাপে সংস্কারমূলক কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে, এটি তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও নাগরিক সমাজের পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত করেই সরকার একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য রূপরেখা উপস্থাপন করতে চায়।
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ তৈরি করতে যাচ্ছে এই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। জাতি অপেক্ষা করছে—কি বার্তা দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, কেমন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান, আর কীভাবে তা বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করেন তিনি।
সকাল থেকেই জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। উপস্থিত থাকবেন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী, পর্যবেক্ষক ও সাধারণ মানুষ। অনেকেই বলছেন, ৬ আগস্ট ২০২৫—এই দিনটিই হতে পারে দেশের নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সূচনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ