
ছবি: সংগৃহীত
সকালে ঘুম ভাঙতেই অনেকের দিনের শুরু হয় প্রিয় এক কাপ চা বা কফির মাধ্যমে। এই অভ্যাস যেন দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যারা অফিসগামী, শিক্ষার্থী কিংবা রুটিনমাফিক জীবনযাপন করেন, তাদের কাছে চা-কফি যেন ঘুমচোখে একমাত্র চেতনা ফেরানোর উপায়।
তবে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা একেবারে শুরু থেকেই এই অভ্যাস নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। বিশেষ করে খালি পেটে চা বা কফি পান করার অভ্যাস শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, এই অভ্যাস দীর্ঘদিন চলতে থাকলে শরীরে নানা রকম জটিলতা তৈরি হতে পারে, যা পরে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খালি পেটে চা-কফি খাওয়ার আগে অন্তত এক মগ বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। সকালে দীর্ঘসময় না খেয়ে ঘুম থেকে ওঠার পর পাকস্থলী থাকে একেবারে খালি। তখন সরাসরি চা বা কফির মতো ক্যাফেইনযুক্ত বা ট্যানিনসমৃদ্ধ পানীয় পান করলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
এই বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ডা. সাবিহা আফরোজ বলেন, “চা বা কফি খালি পেটে খেলে এটি পাকস্থলীর এসিড উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে গ্যাস্ট্রিক, অম্বল, হজমে সমস্যা, এমনকি আলসারের ঝুঁকি পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।”
চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক, খালি পেটে চা বা কফি খাওয়ার ফলে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে—
১. দাঁতের রঙ ও গঠন নষ্ট করে: চা ও কফির অন্যতম উপাদান হলো ট্যানিন, যা দাঁতের ওপর এক ধরনের রাসায়নিক আবরণ তৈরি করে। এটি ধীরে ধীরে দাঁতের স্বাভাবিক রঙ নষ্ট করে ফেলে এবং দাঁতকে হলুদ করে তোলে। নিয়মিত খালি পেটে চা বা কফি খাওয়ার ফলে এই ট্যানিন দাঁতের এনামেলের ক্ষয় ঘটাতে পারে। দাঁত হয়ে পড়ে ভঙ্গুর, আর দেখা দিতে পারে দাঁতের সংক্রমণও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় চা বা কফি খাওয়ার আগে অন্তত এক গ্লাস পানি পান করা উচিত। এতে ট্যানিনের ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও কমে যায়।
২. পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন: অনেকেই মনে করেন, ঘুম ভাঙার পর চা বা কফি খেয়ে শরীর চাঙা হয়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, খালি পেটে এই ধরনের পানীয় পান করলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়।
চা ও কফির অন্যতম উপাদান ক্যাফেইন হলো প্রাকৃতিক ডাইইউরেটিক, অর্থাৎ এটি প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীর থেকে পানি বের হয়ে গিয়ে দ্রুত ডিহাইড্রেশন দেখা দিতে পারে।
তাই ঘুম থেকে উঠে সরাসরি চা-কফি না খেয়ে এক গ্লাস পানি পান করা শরীরের পানি ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে। এরপরই খাওয়ার চিন্তা করা উচিত।
৩. অ্যাসিডিটির ঝুঁকি বাড়ায়: চা ও কফি উভয় পানীয়ই অ্যাসিডিক প্রকৃতির। কফির পিএইচ মান ৫ ও চায়ের পিএইচ মান ৬, যেখানে স্বাভাবিক পানির পিএইচ মান ৭। খালি পেটে এই ধরনের অ্যাসিডিক পানীয় শরীরে গেলে পাকস্থলীতে এসিড উৎপাদন বেড়ে যায়, ফলে দেখা দিতে পারে গ্যাস্ট্রিক, অম্বল, বদহজম ও পেট জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা।
বিশেষ করে যারা নিয়মিত চিনি ও দুধ দিয়ে চা-কফি খান, তাদের ঝুঁকি আরও বেশি। কারণ, দুধে থাকা প্রোটিন ও চিনিতে থাকা গ্লুকোজ পাকস্থলীতে আরও বেশি অ্যাসিড তৈরি করে।
৪. আলসার হওয়ার সম্ভাবনা: খালি পেটে চা বা কফি খাওয়ার সবচেয়ে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো পেটে আলসার হওয়া। এটি প্রথমে গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির মতো হালকা লক্ষণ দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে পাকস্থলীর দেয়ালে ক্ষরণ, ঘা এমনকি রক্তপাতের মতো জটিল সমস্যার দিকে গড়ায়।
চিকিৎসকরা বলেন, দুধ-চিনি মেশানো চা-কফিতে যে মাত্রায় এসিড তৈরি হয়, তা দিনের শুরুতে একেবারে খালি পাকস্থলীতে গেলে তা সরাসরি পাকস্থলীর আবরণী কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দীর্ঘদিন এ অভ্যাস বজায় থাকলে আলসারের আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়।
৫. মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগ: অনেক সময় দেখা যায়, সকালে চা বা কফি খাওয়ার পর মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, মাথা ঘোরে, পেট খারাপ লাগে বা অস্বস্তি তৈরি হয়। এগুলোর অন্যতম কারণ হলো খালি পেটে ক্যাফেইনের প্রভাব।
যাদের শরীর ক্যাফেইনের প্রতি সংবেদনশীল, তাদের জন্য এই প্রভাব হতে পারে আরও বেশি ভয়াবহ। বিশেষ করে খালি পেটে কফি খাওয়া উদ্বেগ, ধকলজনিত মানসিক চাপ এবং ঘনঘন মুড-সুইংয়ের কারণ হতে পারে।
স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে এক গ্লাস উষ্ণ পানি পান করা জরুরি। এটি শরীরের বিপাক ক্রিয়া (metabolism) সক্রিয় করে এবং হজমের প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে।
এরপর চাইলে হালকা নাশতা করে তবেই চা বা কফি পান করা যেতে পারে। আর যদি সময় বা পরিস্থিতির কারণে খালি পেটে চা বা কফি পান করতেই হয়, তাহলে অবশ্যই আগে অন্তত এক গ্লাস পানি পান করুন।
পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকরা সবাই একমত যে, খালি পেটে চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস শরীরের ওপর ধীরে ধীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। অনেক সময় আমরা বুঝতেও পারি না, আমাদের মাথাব্যথা, মেজাজ খারাপ বা পেটের অস্বস্তি—সবকিছুর মূলে রয়েছে এই অভ্যাস।
অথচ একটি ছোট পরিবর্তন—সকালে পানি পান করার অভ্যাস—এত সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে সহজেই।
চা বা কফি শরীরের জন্য একেবারে খারাপ নয়। বরং সময়মতো ও পরিমাণমতো গ্রহণ করলে এগুলো শক্তি জোগাতে পারে, মনোযোগ বাড়াতে পারে এবং শারীরিক ক্লান্তি দূর করতে পারে। তবে ভুল সময়ে, বিশেষ করে খালি পেটে এই পানীয় পান করার অভ্যাস শরীরকে দিন দিন দুর্বল করে তোলে।
সতর্ক হোন, অভ্যাস পরিবর্তন করুন, আর দিন শুরু করুন স্বাস্থ্যকরভাবে। আপনার শরীর আপনাকে ধন্যবাদ দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ