
ছবি: সংগৃহীত
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে—৫ আগস্ট ২০২৪—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো দিন। দীর্ঘ আন্দোলন, বিক্ষোভ ও অসন্তোষের পর পতন ঘটে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। সেদিন ছিল ছাত্র-জনতা, তরুণ প্রজন্ম ও দেশের সর্বস্তরের মানুষের চূড়ান্ত জাগরণের বহিঃপ্রকাশ। আর এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা নিজস্ব অবস্থান থেকে সোচ্চার ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন।
গণজাগরণের দিনগুলোর স্মৃতি আজও তার মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের ঘটনাবহুল দিনটি তার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে—যা তিনি নিজেই বলেন ‘আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত’।
আজমেরী হক বাঁধন শুধু একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী নন—তিনি একজন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ববোধ নিয়ে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের জন্য এক নতুন দৃষ্টান্ত।
জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, সরাসরি রাজপথেও ছিলেন সক্রিয়। শিল্পী সমাজকে সংগঠিত করা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং নির্ভীকভাবে কণ্ঠ তোলা—সবক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল সাহসিকতাপূর্ণ। তিনি একাধারে আন্দোলনের কণ্ঠস্বর এবং অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন।
আজ মঙ্গলবার (৫ আগস্ট ২০২৫) সকালে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি আবেগঘন পোস্ট দেন বাঁধন। সেখানে তিনি লেখেন— "আমি এই দিনটি চিরকাল মনে রাখব। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর সকাল—ভয় আর আশায় ভরা, কিন্তু সাহস আর অটল দৃঢ়তায় পূর্ণ ছিল। কী এক মুহূর্ত ছিল! কী এক অভিজ্ঞতা! এই দিনটা চিরদিনের জন্য আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে।"
পোস্টটি পড়লেই বোঝা যায়, ওই দিন সকাল থেকে তার মনে কেমন দোলাচল চলছিল—ভবিষ্যতের অজানা পরিণতি, অনিশ্চয়তা, ভয়, আবার সেই সঙ্গে দেশের জন্য কিছু ঘটতে চলেছে—এই উপলব্ধি তাকে এক নতুন আবেগে ভরিয়ে দিয়েছিল।
কিছু ঘণ্টা পর তিনি আরেকটি পোস্ট করেন, যেখানে তিনি আরও গভীরভাবে স্মৃতিচারণ করেন সেই অবিস্মরণীয় দিনের দুপুরবেলার। তিনি লেখেন— "যখন খবর ছড়িয়ে পড়ে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন—জনতার গর্জনে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তখন যে উল্লাস, যে বিস্ফোরণ জনতার মাঝে দেখা গিয়েছিল, তা আমি জীবনে কখনো দেখিনি। বাসায় বসে, অফিস থেকে বা শুধু সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করে এই অনুভূতি বোঝা যাবে না। এটা বুঝতে হলে আপনাকে সেখানে থাকতে হতো।"
এই কথাগুলোতে স্পষ্ট যে, বাঁধনের অভিজ্ঞতা ছিল প্রত্যক্ষ, এবং তিনি সেটা হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করেছেন। সেই মুহূর্তে যারা রাজপথে ছিলেন, তারা শুধু সরকারের পতন দেখেননি, তারা একসঙ্গে স্বাধীনতার স্বাদও অনুভব করেছিলেন।
তিনি আরও লিখেছেন— "পুরো জাতি একসঙ্গে জেগে উঠেছিল। কেউ কেঁদেছে, কেউ হেসেছে, কেউ নেচেছে, কেউ স্লোগান দিচ্ছিল। বাতাসে ছিল স্বাধীনতার বিদ্যুৎ। সেই মুহূর্তটাই আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি। আমি বাংলাদেশের মানুষদের নিয়ে গর্বিত। কী এক বিজয়! কী এক অসাধারণ সাফল্য!"
এই ভাষ্য শুধু একজন অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, বরং তা গোটা জাতির আবেগকে ধারণ করে। সেই দিন জাতি যেমনভাবে জেগে উঠেছিল, সেই অনুভূতির প্রতিফলন পাওয়া যায় বাঁধনের লেখায়।
শুধু পোস্ট নয়, আন্দোলনের সময় বাঁধনের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও উল্লেখযোগ্য। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত আপডেট দিয়েছেন, অন্য শিল্পীদেরও একতাবদ্ধ করেছেন, মিছিল ও মানববন্ধনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, গণজাগরণে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। অনেকসময় নারীদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিজেও হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সরাসরি না থেকেও একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বাঁধনের এই ভূমিকা অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার সেই সময়ের ছবি, বক্তব্য ও ভিডিওগুলো এখনো ভাইরাল হয়ে ঘুরছে নেটমাধ্যমে।
আজ, আন্দোলনের এক বছর পর, বাঁধনের স্মৃতিচারণ এবং তার কণ্ঠে ফুটে ওঠা গর্ব যেন একটি বড় অধ্যায়। তিনি শুধু একজন অভিনেত্রী নন—তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সচেতন নাগরিক, প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী একজন সংগ্রামী মানুষ।
এই বছরজুড়ে দেশের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু যারা আন্দোলনের সেই দুরন্ত দিনগুলোতে সামনে ছিলেন, তাদের মতো মানুষদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা আজও প্রাসঙ্গিক।
আজমেরী হক বাঁধনের ভাষায়, “আমরা শুধু ইতিহাসের অংশ নই, আমরা ইতিহাস গড়েছি। ৫ আগস্ট ছিল সেই রূপান্তরের দিন। আমি গর্বিত, আমি সেই দিনের সাক্ষী।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ