
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩ জনের মৃত্যু এবং নতুন করে ৩১৯ জন রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় যেসব রোগী মারা গেছেন, তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। মৃতদের মধ্যে দুইজনের বাড়ি চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এবং একজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। এ নিয়ে ২০২৫ সালে ডেঙ্গুজনিত কারণে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৮৯ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণকারী ৮৯ জনের মধ্যে ৫১ জন পুরুষ এবং ৩৮ জন নারী।
এ বছর এখন পর্যন্ত দেশে মোট ২২ হাজার ৩৮৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৩ হাজার ১২৮ জন পুরুষ এবং ৯ হাজার ২৫৬ জন নারী। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, পুরুষ আক্রান্তের হার কিছুটা বেশি।
ডেঙ্গু সংক্রমণ আর শুধু রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক নেই। দেশের বিভিন্ন বিভাগ, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ মৃত্যুর তালিকায় চট্টগ্রামের দুইজন থাকা থেকেই স্পষ্ট, ঢাকার বাইরে পরিস্থিতিও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক হলেও ডেঙ্গুর বিস্তার যদি সময়মতো নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে পরিস্থিতি দ্রুত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাদের মতে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি করপোরেশন এবং সাধারণ জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বিশিষ্ট সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মনজুরুল হক বলেন, “আমরা আগেই জানি যে জুলাই-আগস্ট মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু মৃত্যুহার বাড়া একটি অশনি সংকেত। বিশেষ করে উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর যদি রোগীকে দেরিতে হাসপাতালে নেওয়া হয়, তাহলে জটিলতা বাড়ে।”
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করার দাবি করলেও সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ, অনেক এলাকায় এখনো নিয়মিত ফগিং বা কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা নিয়মিত ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে টিম পাঠাচ্ছি। তবে অনেক সময় এলাকাবাসীর অসহযোগিতার কারণে কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। বাড়ির চারপাশে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে কিংবা ড্রাম বা বালতিতে জমে থাকা পানি মশা বংশবিস্তার করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ শুরু করতে হবে। নিয়মিতভাবে জমা পানি ফেলে দেওয়া, মশারি ব্যবহার করা, ফুলের টব পরিষ্কার রাখা এসব ছোট ছোট কাজই বড় বিপদ ঠেকাতে পারে।”
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। অনেক হাসপাতালের আইসিইউ বেড ইতিমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব রোগীদের শরীরে রক্তক্ষরণ বা প্লেটলেট স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে, তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন হচ্ছে।
ঢাকার একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক জানান, “প্রতিদিনই নতুন করে রোগী আসছেন। কিছু রোগীর অবস্থা আসার সময়ই গুরুতর থাকে। এদের জন্য দ্রুত প্লাজমা বা রক্তের প্রয়োজন হয়।”
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি একটি বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। সংক্রমণের গতি রোধে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই কেবল এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিনের আপডেটের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ