
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই অনুষ্ঠানটি ছিল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যেখানে জাতির পিতা ও ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ সংকল্পকে সংবিধানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণাপত্র শুধু একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নয়, বরং বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল গণআন্দোলনের নীরব কিন্তু প্রগাঢ় দলিল, যা আগামী প্রজন্মের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
উক্ত ঘোষণাপত্রে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে, যে বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে উপনিবেশবিরোধী ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই চলেছে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের ২৩ বছরের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ গড়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আজকের সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের গৌরবোজ্জ্বল সংবিধান প্রণয়ন ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের কারণে গণতন্ত্রের যথাযথ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
জুলাই ঘোষণাপত্রে স্মরণ করা হয়েছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসন ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব এবং বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ভেঙে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের উল্লেখযোগ্য অবদান। কিন্তু আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রায় দশ বছর ধরে ছাত্র-জনতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান সফল হয় এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
যদিও ১৯৯১ সালের পর গণতন্ত্র ফিরলেও, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেশে একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত ও পরিকল্পনা দৃশ্যমান ছিল। ১/১১ ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, তিনবারের (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যাহত হওয়ার ঘটনা, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণের পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের বিস্তৃত ইতিহাস ঘিরে রয়েছে এই সময়কাল।
জুলাই ঘোষণাপত্র স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছে, এই দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জনগণের ওপর নির্বিচার গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দমন-পীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ একযোগে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল হয়। এই আন্দোলনের পর্যায়ে প্রায় এক হাজার নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষ নিহত এবং হাজারো মানুষ অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বে পতিত হয়।
তবে গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের পক্ষে অবস্থান নেয়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সফলতায় অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে ফেলা হয় এবং সংবিধানের ধারা ১০৬ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই অন্তর্বর্তী সরকার দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন ও সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনে কাজ করছে।
জুলাই ঘোষণাপত্রে জনগণ তাদের প্রত্যাশার সুস্পষ্ট ভাষায় জানায়—ফ্যাসিবাদী শাসন, বৈষম্য, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা তীব্র। আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার রক্ষা, সুশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ একটি উন্নত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, পরিবেশ-বান্ধব ও টেকসই রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এছাড়া ঘোষণা করা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, শহীদ পরিবার ও আহতদের প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা দেওয়া হবে এবং আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের তফসিলে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ সংযোজন করা হবে। এতে গণঅভ্যুত্থানের তাৎপর্য ও ইতিহাস সংবিধানিক মর্যাদা পাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আদর্শ স্থাপন করবে।
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ শুধু এক বছরের গণঅভ্যুত্থানের স্মারক নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নতুন অধ্যায় ও গণতন্ত্রের নবজাগরণের পথপ্রদর্শক। এটি দেশের সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ চেতনার প্রতিফলন, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকারকে সুসংহত করতে, ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে।
আগামীতে এই ঘোষণাপত্রের অন্তর্ভুক্তি সংবিধানে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, মানবাধিকারসম্মত, দুর্নীতি-রহিত, পরিবেশবান্ধব ও সকলের জন্য ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ