
ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজার সফর নিয়ে উদ্ভূত বিতর্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ওঠার পর দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী দিয়েছেন লিখিত জবাব। এই জবাবে তিনি শোকজকে ‘অসভ্য জগতে সভ্যতার নিদর্শন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। একইসঙ্গে নিজের সফরকে ‘ব্যক্তিগত মানসিক অনুশীলন’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
সম্প্রতি এনসিপির পাঁচজন শীর্ষ নেতা—নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, ডা. তাসনিম জারা ও খালেদ সাইফুল্লাহ—একসঙ্গে কক্সবাজার ভ্রমণে গেলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে দলীয় দপ্তর থেকে তাঁদের প্রত্যেককে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। এই প্রেক্ষাপটেই নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে লিখিত জবাব দিয়েছেন মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
জবাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ৫ আগস্ট তারিখে তাঁর কোনো পূর্বনির্ধারিত রাষ্ট্রীয় বা সাংগঠনিক কর্মসূচি ছিল না, এমনকি দল থেকেও তাকে সে ধরনের কোনো দায়িত্ব জানানো হয়নি। তাই সেই সময়টুকু তিনি নিজের মতো করে কাটিয়েছেন, তবে উদ্দেশ্যহীনভাবে নয়। বরং তিনি এই সফরকে একটি ‘গভীর রাজনৈতিক আত্মমগ্নতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি লেখেন, “আমি ঘুরতে গিয়েছিলাম, তবে এই ঘোরার লক্ষ্য ছিল রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে একান্তে চিন্তা-ভাবনা করা। সাগরের পাড়ে বসে আমি গভীরভাবে ভাবতে চেয়েছি গণ-অভ্যুত্থান, নাগরিক কমিটি, নাগরিক পার্টির কাঠামো, ভবিষ্যৎ গণপরিষদ এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের রূপরেখা নিয়ে। আমি এটিকে কোনো অপরাধ মনে করি না, বরং একজন রাজনৈতিক কর্মীর জন্য এটি একটি দায়িত্বশীল মানসিক চর্চা।”
তিনি আরও বলেন, রাজনীতি মানেই কেবল জনসভা আর বক্তৃতা নয়, বরং কখনও কখনও নিরিবিলি পরিবেশে বসে দলের ভবিষ্যৎ কাঠামো, আদর্শিক ভিত্তি ও কৌশলগত রূপরেখা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করাটাও রাজনৈতিক দায়িত্বের অংশ। এই আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ হিসেবেই তিনি কক্সবাজার সফরকে বেছে নিয়েছিলেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী তাঁর জবাবে সফর ঘিরে ছড়িয়ে পড়া একটি গুজবের বিষয়েও সরাসরি বক্তব্য রেখেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, “কক্সবাজার পৌঁছানোর পর হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, আমরা নাকি সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি তাৎক্ষণিকভাবে গণমাধ্যমকে জানাই, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। হোটেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে জানায় সেখানে পিটার হাস নামে কেউ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তিনি তখন ওয়াশিংটনে অবস্থান করছিলেন।”
এই গুজবকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ‘ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার’ বলেই দেখছেন তিনি।
শোকজ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “পরিস্থিতির আলোকে আমি মনে করি, এই শোকজ বাস্তবভিত্তিক নয়। আমার সফর ছিল স্বচ্ছ, সাংগঠনিক নীতিমালাবিরোধী নয় এবং একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার সুযোগ মাত্র। তবুও দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং রাজনৈতিক শালীনতা বজায় রেখে আমি এই লিখিত জবাব প্রদান করছি— অসভ্য জগতে সভ্যতার এক নিদর্শন হিসেবে।”
এই বক্তব্যে শোকজের প্রতি তার আপাত সম্মান দেখালেও, তার সফরের যৌক্তিকতাও তুলে ধরেছেন পাটওয়ারী। মূলত তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, দলীয় আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো উদ্দেশ্য বা চর্চা তাঁর এই সফরে ছিল না।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীসহ এনসিপির পাঁচ শীর্ষ নেতা কক্সবাজার সফরে যান। এই সফরকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে এনসিপির বিরোধপূর্ণ অবস্থান এবং বিদেশি কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে চলমান আলোচনা মাথায় রেখে এই সফর নিয়ে গুঞ্জন তৈরি হয়।
এর প্রেক্ষিতেই জাতীয় নাগরিক পার্টির দপ্তর থেকে হাসনাত আবদুল্লাহ (দক্ষিণাঞ্চল), সারজিস আলম (উত্তরাঞ্চল), ডা. তাসনিম জারা (জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব) এবং খালেদ সাইফুল্লাহ (যুগ্ম আহ্বায়ক)-এর পাশাপাশি পাটওয়ারীকেও কারণ দর্শাতে বলা হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এনসিপির ভেতরে ও বাইরে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে। পাটওয়ারীর জবাব কিছু সমর্থকের কাছে ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক পরিপক্বতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হলেও, অন্য অংশের মতে, এটি একধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের কৌশল মাত্র।
তবে একথা বলতেই হয়, রাজনৈতিক জীবনে শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতা যেমন জরুরি, তেমনি ভিন্নমত ও ব্যক্তিগত রাজনৈতিক চর্চার স্বাধীনতাও গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর জবাব সেই দ্বৈত ভারসাম্য রক্ষা করার একটি প্রচেষ্টা বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ