
ছবি: সংগৃহীত
নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কার্যক্রম ও গোপন গেরিলা প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আলোচিত সেনা কর্মকর্তা মেজর সাদিকের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে রাজধানীর ভাটারা থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত এই আদেশ দেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি বিশেষ টিম তাকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে হাজির করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সেফাতুল্লাহ জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, “আসামি একটি স্পর্শকাতর ও রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বলে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। তার কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য উদঘাটনের জন্য রিমান্ড প্রয়োজন।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল ও জামিন আবেদন করেন। তাদের যুক্তি ছিল, সুমাইয়া জাফরিন একজন গৃহবধূ, তিনি শুধু মেজর সাদিকের স্ত্রী হিসেবে পরিচিত। কোনো অবৈধ কার্যক্রমে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। এছাড়া তাকে আটকের প্রক্রিয়াটিও ছিল বেআইনি বলে দাবি করেন আইনজীবীরা।
তবে উভয় পক্ষের যুক্তি শুনে বিচারক রিমান্ডের আবেদন আংশিক মঞ্জুর করেন এবং জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মেজর সাদিকের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনায় স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এমন অভিযোগে তার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। তার গোপন যোগাযোগ, মিটিং এবং ফান্ড ট্রান্সফারের তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে আসে।
এরপর ডিবি পুলিশের একটি দল রাজধানীর একটি স্থানে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে। পরে ভাটারা থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে রিমান্ডে নেয়া হয়।
এই মামলার পটভূমিতে রয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীর গোপন বৈঠক এবং কথিত ‘গেরিলা প্রশিক্ষণ’ সংক্রান্ত ঘটনা। গত ৩১ জুলাই রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে এক গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণকালে তাদেরকে আটক করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন ২২ জন নেতা-কর্মী।
পুলিশ জানায়, বৈঠকটি ছিল একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ, যার মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। এই ঘটনায় রাজধানীর ভাটারা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় একটি মামলা দায়ের করা হয় এবং মামলাটির তদন্তভার দেয় হয় ডিবিকে।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আলোচনায় আসেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর সাদিক। গত ১ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানায়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ১৭ জুলাই মেজর সাদিককে রাজধানীর উত্তরা থেকে আটক করে সেনাবাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে গোপনে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এবং গেরিলা প্রশিক্ষণের পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
আইএসপিআর জানায়, “সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের লক্ষ্যে একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে এবং প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। পূর্ণ তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এছাড়াও, সেনা তদন্তের পাশাপাশি পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঘটনাটি বহুমাত্রিকভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, মামলার তদন্তে মেজর সাদিক ও সুমাইয়া জাফরিন ছাড়াও আরও কয়েকজন ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, যারা গোপনে অর্থায়ন, যোগাযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তদন্ত সংস্থাগুলো এখন এসব ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে এবং সম্ভাব্য নেটওয়ার্ক ছিন্ন করতে প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা উপাত্ত বিশ্লেষণ করছে।
মেজর সাদিক ও তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে ঘিরে উদ্ভূত ঘটনাপ্রবাহ দেশের নিরাপত্তা ও রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্ত, পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুসারে পরিচালিত অনুসন্ধান এবং বিচারিক প্রক্রিয়া—সব মিলিয়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হতে যাচ্ছে। এই মামলার রায়ে কী হয় তা শুধু একটি ব্যক্তিগত বিচার নয়, বরং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নেও তাৎপর্য বহন করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ