
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া এক সাক্ষাৎকার এখন বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। সাক্ষাৎকারের একটি অংশ ঘিরে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও ভবিষ্যতে তা তুলে নেওয়া হতে পারে—এমন ব্যাখ্যা ছড়িয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছে। একে ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া এবং নানা প্রশ্ন।
ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিওর সাংবাদিক মেহদি হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত ও কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে। এর জবাবে তিনি স্পষ্ট করেন—
-
আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়নি, বরং কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
-
তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতে পারবে না এবং নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
-
তবে দলটি এখনও বৈধ, শুধু কার্যক্রম স্থগিত।
-
যেকোনো সময় এই স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া যেতে পারে—এমন সম্ভাবনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
তবে তার বক্তব্যের প্রসঙ্গ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেক গণমাধ্যম শিরোনাম করে যে আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা “যে কোনো সময় তুলে নেওয়া হতে পারে।” এ বক্তব্যই এখন রাজনীতির নতুন বিতর্কে পরিণত হয়েছে।
প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর অধীনে থাকা ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম বাংলাফ্যাক্ট দাবি করেছে, ড. ইউনূসের বক্তব্য বিকৃতভাবে প্রচার করা হয়েছে। তিনি আসলে বলেছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত, কারণ নির্বাচন কমিশনের মতে, দলটি নির্বাচনে অংশ নিলে প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এছাড়া, তিনি স্পষ্ট করেছিলেন—এটি ফর দ্য টাইম বিয়িং, অর্থাৎ আপাতত।
বাংলাফ্যাক্ট সাক্ষাৎকারের ইংরেজি অংশও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায় ইউনূস স্পষ্ট করে বলেছেন— “আওয়ামী লীগ বৈধ দল হিসাবে থাকবে, কিন্তু তাদের কার্যক্রম স্থগিত। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।”
অর্থাৎ, সরাসরি “নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হতে পারে”—এমন কোনো নিশ্চয়তা তিনি দেননি।
এমন বিভ্রান্তি ও ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
-
বিএনপি : স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ হোসেন বলেছেন, “গণহত্যার দায় থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। বিচার না হওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম সচল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।” তিনি আরও যোগ করেন, জনগণকে গুলি করে হত্যাকারী দলকে পুনর্বাসন করা গণতন্ত্রবিরোধী।
-
জামায়াত : কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ মন্তব্য করেন, “জনগণ ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগকে গণহত্যাকারী দল হিসেবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে জনগণই প্রতিহত করবে।”
-
গণতন্ত্র মঞ্চ : নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “আওয়ামী লীগকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল জনসেন্টিমেন্টের কারণে। এখন হঠাৎ কেন এ নিয়ে এমন মন্তব্য করা হলো, তা বোধগম্য নয়। নির্বাচনের আগে যদি স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হয়, নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।”
-
গণঅধিকার পরিষদ : সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ব্যঙ্গ করে বলেন, “যেহেতু সরকার আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে কাজ করছে, চাইলে তাদের কোনো উপদেষ্টাকেই দলটির প্রধান করে দেওয়া যেতে পারে।”
-
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) : আব্দুল হান্নান মাসউদ সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “প্রধান উপদেষ্টা এই বক্তব্য প্রত্যাহার করুন। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী সংগঠন, তাদের সঙ্গে কোনো আপস নয়।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, “নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অদূর ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পুনরায় চালুর সুযোগ নেই।”
একইভাবে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “এটি কেবল অনুবাদের বিভ্রান্তি। ড. ইউনূস কোনো সময় বলেননি যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। বরং তিনি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। মিডিয়া কিছু জায়গায় ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে এই বিতর্ক নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। একপক্ষ বলছে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখা জরুরি; অন্যপক্ষ বলছে, একটি বড় রাজনৈতিক দলকে মাঠের বাইরে রাখলে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠবে।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিতাদেশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সরকার বলছে, নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে; রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, বিচার ছাড়া আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ নেই। তবে আন্তর্জাতিক মহলে এ বিতর্ক কীভাবে প্রতিফলিত হবে এবং নির্বাচনের আগে এর কী প্রভাব পড়বে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ