
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালান ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার আলোচনায় উঠে এসেছেন শ্যাম ঘোষ নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী। একসময় একটি ছোট খাবার হোটেলে কাজ করা এই ব্যক্তি ধাপে ধাপে অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে বিভিন্ন স্বর্ণের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ নিলেও পরবর্তীতে তিনি কাগজপত্রবিহীন স্বর্ণ কেনাবেচার মাধ্যমে বড় ধরনের চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হন। দীর্ঘদিনের এই অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে ঢাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, স্বর্ণের দোকান, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান তিনি।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে, শ্যাম ঘোষের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর অধীনে মামলা রয়েছে। মামলার তদন্তে উঠে এসেছে, তিনি বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় করতেন এবং এর মাধ্যমে অর্জিত টাকায় অবৈধভাবে সম্পদ গড়েছেন। তদন্তে প্রমাণিত হয়, এসব সম্পদ অপরাধলব্ধ আয় গোপন করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নামে ও যৌথ মালিকানায় কেনা হয়েছে।
সিআইডি ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, শ্যাম ঘোষের প্রায় ১০ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি চিহ্নিত করে আদালতে আবেদন করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র মহানগর স্পেশাল জজ আদালত ২৫ সেপ্টেম্বর ওই সম্পত্তির উপর ক্রোকাদেশ দেন। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে ডিএমপি পুলিশ কমিশনারকে ক্রোককৃত সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য রিসিভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, শ্যাম ঘোষ অবৈধ আয়ে ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। তার মধ্যে রয়েছে কোতয়ালী থানাধীন ওয়াইজঘাটে অবস্থিত ‘বাবুলী স্টার সিটি’ ভবনের ৫ম তলার একটি ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নং ৪/সি) এবং স্বামীবাগে ‘স্বর্ণচাপা’ ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় নিজ ও তার ভাইয়ের যৌথ মালিকানাধীন একটি ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নং এ-৬)। এছাড়া তিনি জনপ্রিয় শপিং মল বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের ব্লক-বি, লেভেল-৫-এ ‘নন্দন জুয়েলার্স’ নামের একটি স্বর্ণের দোকানেরও যৌথ মালিক।
এখানেই শেষ নয়, শ্যাম ঘোষ তার অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন যমুনা ফিউচার পার্কের ৬ষ্ঠ তলার সি ব্লকে তিনটি দোকানে (দোকান নং ৫সি-০৫৪, ৫সি-০৫৫, ৫সি-০৫৬)। এছাড়া তিনি ‘ইন্ডিয়ান ডোমেস্টিক স্পাই’ নামের একটি রেস্টুরেন্টও প্রতিষ্ঠা করেছেন। তদন্তকারীরা বলছেন, এগুলো তার অবৈধ আয়ের প্রতিফলন, যেগুলো মূলত স্বর্ণ চোরাচালান থেকে আসা অর্থ দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে।
সিআইডি জানিয়েছে, শ্যাম ঘোষের কর্মজীবনের শুরু ছিল ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় তার পিতার একটি খাবার হোটেলে। সেখান থেকে তিনি ধীরে ধীরে স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। স্বর্ণের দোকানে চাকরি করতে করতেই তিনি বুঝতে পারেন কাগজপত্র ছাড়া স্বর্ণ কেনাবেচার অবৈধ কিন্তু লাভজনক পথ। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিশে যান এবং ক্রেতা-বিক্রেতার চেইন তৈরি করে ফেলেন। এই প্রক্রিয়াতেই তিনি স্বর্ণের বৈধ ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ অর্জন করেন।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, শ্যাম ঘোষ কেবল একজন ব্যবসায়ী নন; তিনি স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের অন্যতম মূল হোতা। বৈধ আমদানির বাইরে যে বিপুল স্বর্ণ অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করছে, তার একটি বড় অংশ এই ধরনের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এতে যেমন সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি দেশে মানি লন্ডারিং অপরাধও বাড়ছে।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। সিআইডি বলছে, তদন্তে আরও নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে এবং প্রমাণিত হলে শ্যাম ঘোষের অবশিষ্ট সম্পত্তিও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মনে করছে, এ ধরনের চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে দেশে অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। কারণ, তারা শুধু স্বর্ণ ব্যবসার ক্ষতি করছে না, বরং অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ