
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। শেষ পর্যন্ত বন্দর বোর্ডের সর্বশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নতুন ট্যারিফ সূচি কার্যকর হবে আগামী ১৪ অক্টোবর রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে। অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার যে আগের ঘোষণা ছিল, তা ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট মহলের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, আর কোনো বিলম্ব হবে না। নির্ধারিত সময় থেকে বন্দরসংশ্লিষ্ট সব খাতেই নতুন মাশুল আদায় শুরু হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, নির্ধারিত সময় থেকে বন্দরে আগত সব ধরনের জাহাজের ভাড়া বিল, কনটেইনার চার্জ, কার্গো বিলসহ সব ধরনের ফি ও টোল নতুন হারে আদায় করা হবে। শুধু তাই নয়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও নৌপরিবহন এজেন্টদেরও নতুন সূচি অনুযায়ী অর্থ জমা দিতে হবে। জাহাজ ছাড়পত্র (এনওসি) আবেদন থেকে শুরু করে ব্যাংক হিসাব খোলা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই নতুন নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “আমরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। ১৪ অক্টোবর রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে নতুন মাশুল কার্যকর হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে জারি করা প্রজ্ঞাপনে প্রথমবারের মতো মাশুল বৃদ্ধির ঘোষণা আসে। তাতে বলা হয়েছিল, বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল বাড়ানো হবে। তবে পরদিন থেকেই ব্যবসায়ী মহলসহ আমদানি-রপ্তানিকারকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। তাদের অভিযোগ ছিল, হঠাৎ এত বড় অঙ্কে মাশুল বাড়ানো হলে ব্যবসার খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে, যা রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেবে।
এই প্রতিক্রিয়ার মুখে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ২০ সেপ্টেম্বর সিদ্ধান্ত স্থগিত করার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, ব্যবসায়ী মহলের মতামত বিবেচনায় রেখে এক মাস সময় নিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার পর এবার আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন কার্যকর তারিখ জানানো হলো।
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে ৫২টি খাতে মাশুল আদায় করা হয়। এর মধ্যে ২৩টি খাতে নতুন হারে ট্যারিফ সরাসরি কার্যকর হবে। গেজেট অনুযায়ী, ভাড়া, টোল, ফি ও মাশুল ডলারের বিনিময়মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে আদায় করা হবে। প্রতি ডলারের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১২২ টাকা। ফলে ডলারের মান বাড়লেই মাশুল স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে।
সবচেয়ে বেশি মাশুল বেড়েছে কনটেইনার পরিবহন খাতে। প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য নতুন মাশুল ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। আগে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি কনটেইনারে বাড়তি ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা গুনতে হবে, যা গড়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি।
এ ছাড়া আমদানি কনটেইনারে বাড়তি ৫ হাজার ৭২০ টাকা, আর রপ্তানি কনটেইনারে বাড়তি ৩ হাজার ৪৫ টাকা দিতে হবে। প্রতিটি কনটেইনার ওঠা-নামার ক্ষেত্রেও প্রায় ৩ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, কনটেইনার পরিবহন খাতে ২৫ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বাড়বে।
আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক সংগঠনগুলোর দাবি, হঠাৎ করে এত বড় অঙ্কে মাশুল বৃদ্ধির ফলে দেশের পণ্য আমদানি ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি রপ্তানিপণ্যের খরচও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা আরও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এ খরচ শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, যার ফলে বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন মাশুল কার্যকর করতে বিল প্রস্তুতের সফটওয়্যার দ্রুত হালনাগাদ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সফটওয়্যার উন্নয়ন, পদ্ধতি যাচাই এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের কাজ দ্রুত শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, এভাবে পুরো প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভুল রাখা সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন মাশুল কার্যকর হলে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব বাড়বে বটে, তবে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যেখানে বাংলাদেশকে আগে থেকেই নানা প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে, সেখানে বাড়তি ব্যয় ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন চাপ তৈরি করবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, আগামী ১৪ অক্টোবর রাত থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন মাশুল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রমে এক বড় পরিবর্তন আনবে। এখন দেখার বিষয়, ব্যবসায়ী মহলের আশঙ্কা কতটা সত্য হয় এবং সরকার ও বন্দর কর্তৃপক্ষ এর প্রভাব মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাবার্তা/এসজে