
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট শপথ নিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার পথচলা শুরু করেছিল, সেই সরকারের এক বছর পূর্তি হচ্ছে আগামী শুক্রবার (৮ আগস্ট, ২০২5)। এই এক বছরের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি, নাগরিক অধিকার, নির্বাচন এবং সামুদ্রিক অর্থনীতি পর্যন্ত নানা খাতে পরিবর্তনের ছাপ রেখেছে এই সরকার।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের ১২টি মূল অর্জনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। এই অর্জনগুলো শুধু একটি বছরের প্রশাসনিক ফলাফল নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি কাঠামোগত ভিত্তিও গড়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
১. শান্তি ও স্থিতিশীলতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
২০২৪ সালের ভয়াবহ জুলাই অভ্যুত্থান ও সংঘাতের পর জাতি এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে পড়েছিল। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ভেতরে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। বিদ্বেষ, প্রতিশোধ, সংঘাত থেকে সরে এসে একটি সমঝোতাপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলে সরকার, যার মাধ্যমে দেশে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার ভিত্তি নির্মাণ শুরু হয়।
২. অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন
জুলাই সংঘাতের পর অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নয়ন হয়েছে:
-
খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ১৪% থেকে কমে প্রায় ৭% হয়েছে
-
সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি কমে ৮.৪৮% (৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন)
-
রেমিট্যান্স ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলার (রেকর্ড
-
রপ্তানি বেড়েছে ৯%
-
টাকার মান ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে
-
ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ফিরেছে
৩. বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সাফল্য
বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে পুনঃসম্পর্ক তৈরি করে বাংলাদেশ বড় আকারের বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে চীনের হান্ডা গ্রুপের ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এবং ২৫ হাজার কর্মসংস্থানের ঘোষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য শুল্ক বিষয়ে আলোচনায় সফলতা এসেছে এবং বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) গত সরকারের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।
৪. গণতান্ত্রিক সংস্কার ও ঐতিহাসিক “জুলাই সনদ”
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার গঠন করে “সংস্কার কমিশন” এবং ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে তৈরি করে ঐতিহাসিক “জুলাই সনদ”। এই সনদ গণতান্ত্রিক ভারসাম্য (check & balance), স্বচ্ছতা এবং ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদ রোধে আইনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে।
৫. জুলাই গণহত্যার ন্যায়বিচার
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪টি বড় ট্রায়াল শুরু হয়েছে এবং বিচারের আওতায় আনা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, আইনের শাসন এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।
৬. নির্বাচনী রোডম্যাপ ও নতুন সংস্কার
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রথমবারের মতো প্রবাসীদের ভোটার অন্তর্ভুক্তি, নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নাগরিক পরামর্শ প্ল্যাটফর্ম, ৮ লাখ নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েনের পরিকল্পনা, ও নির্বাচনকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করার প্রস্তাব জনমনে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।
৭. আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
-
বিচার বিভাগ: নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এনে স্বাধীনতা বৃদ্ধি
-
পুলিশ: মানবাধিকার সেল, বডিক্যাম, স্বচ্ছ জিজ্ঞাসাবাদ রুম চালু
-
আইন: গ্রেপ্তারের পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারের কাছে তথ্য পৌঁছানো বাধ্যতামূলক; আইনজীবী ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিতকরণ; ডিজিটাল জিডি বাধ্যতামূলক
৮. সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অধিকার
দমনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সরকার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে থাকা সকল মামলা প্রত্যাহার এবং ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান দেশে প্রথমবারের মতো হয়েছে।
৯. ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি
সরকার একক নির্ভরতা থেকে সরে এসে মাল্টিপোলার কূটনীতি অনুসরণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারতসহ নানা অংশীদারের সঙ্গে বাণিজ্য, চিকিৎসা ও জলবায়ু সহযোগিতা জোরদার করেছে। সার্ক পুনরুজ্জীবন ও আসিয়ান সদস্যপদের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে।
১০. প্রবাসী ও শ্রমিক অধিকারে অগ্রগতি
-
আমিরাতের ভিসা পুনরায় চালু
-
মালয়েশিয়ায় মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালু
-
জাপান, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও সার্বিয়ায় কর্মী প্রেরণ প্রকল্প
-
উপসাগরীয় অঞ্চলে অনিবন্ধিত শ্রমিকদের নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়া শুরু
১১. যোদ্ধা পরিবার ও আহতদের সহায়তা
-
৭৭৫ শহীদ পরিবারকে ১০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ও ভাতা
-
১৩,৮০০ আহত যোদ্ধাকে ১৫৩ কোটি টাকার সহায়তা
-
গুরুতর আহতদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হয়েছে
১২. সামুদ্রিক অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়ন
বঙ্গোপসাগরকে জাতীয় “জলভিত্তিক অর্থনীতির কেন্দ্র” ঘোষণা করে গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় অর্থনীতি উন্নয়ন ও বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার বিষয়ে নতুন নতুন চুক্তি করা হয়েছে।
এই ১২টি অর্জন শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক সক্ষমতা নয়, বরং একটি সামগ্রিক রূপান্তরের সূচনা বলেই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। আগামী দিনে এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎ নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারে। প্রেস সচিবের মতে, “এই অর্জনগুলো জাতিকে দেখিয়েছে, সংকট থেকে সমাধানের পথ তৈরি সম্ভব—যদি নেতৃত্বে থাকে দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও জনসম্পৃক্ততা।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ