
ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েল সরকার গাজা উপত্যকায় একটি নতুন ও বহুল আলোচিত সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে, যার সময়সীমা ধরা হয়েছে পাঁচ মাস। এই অভিযানের লক্ষ্য গাজার আরও কিছু এলাকা দখল এবং গাজা শহরের অন্তত ১০ লাখ মানুষকে জোরপূর্বক স্থানচ্যুত করা। বুধবার (৬ আগস্ট) এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়, যা বৃহস্পতিবারই ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রত্যক্ষ সমর্থনে প্রণীত এই পরিকল্পনার আওতায় অন্তত পাঁচটি আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) ডিভিশন মোতায়েন করা হবে গাজার বিভিন্ন অংশে। এর মধ্যে কৌশলগত কিছু এলাকাকে দখলের পাশাপাশি অস্ত্র ও যোদ্ধা সরবরাহের পথগুলো ধ্বংস করার লক্ষ্য রয়েছে।
নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য, যাঁরা পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি, ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই পরিকল্পনা হয়তো বৃহস্পতিবারেই অনুমোদন পাবে। তবে এখনো নিশ্চিত নয়, ঠিক কোন সংস্করণটি অনুমোদন পাবে—সম্পূর্ণ সামরিক দখলের একটি জোরালো রূপ, নাকি সীমিত সামরিক নিয়ন্ত্রণের একটি বিকল্প মডেল।
বিশ্লেষকদের ধারণা, এটি বাস্তবায়িত হলে গাজা উপত্যকায় চলমান মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। কারণ এত বিপুল সংখ্যক মানুষের স্থানচ্যুতি, মৌলিক সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং খাদ্য ও পানির সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
ইসরায়েলি সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে সতর্ক করেছেন যে, এটি “একটি গুরুতর ভুল” হতে পারে। তিনি মনে করেন, গাজায় এই অভিযানের ফলে সেখানে হামাসের হাতে আটক থাকা জিম্মিদের জীবন চরম ঝুঁকিতে পড়বে।
মঙ্গলবার এক বৈঠকে সেনাপ্রধান বলেন, “এই ধরনের সামরিক পদক্ষেপ কৌশলগতভাবে আমাদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। এটি শুধুমাত্র আমাদের আটক নাগরিকদের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলবে না, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে ইসরায়েলের অবস্থান দুর্বল করে তুলবে।”
যদিও তিনি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন, তবু পদত্যাগ করবেন না বলেও জানিয়েছেন। সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের এই দ্বিমত পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
এই সামরিক পরিকল্পনার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে, এমনটাই মনে করছেন ইসরায়েলি নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক মহলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জেরুজালেম পোস্ট–কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তত দুটি সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা এই পরিকল্পনা নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে জোর আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্র গাজায় মানবিক সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।” এর মধ্যে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ রয়েছে।
এদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি গাজার জনগণের জন্য খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে। এতে ইসরায়েলকে সাহায্য করতে হবে, এবং আরব রাষ্ট্রগুলোকেও ভূমিকা রাখতে হবে।”
গাজা পুরোপুরি দখলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কৌশলী জবাবে বলেন, “এটা ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত।”
গাজা উপত্যকায় দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অভিযান, ১০ লাখ মানুষের সম্ভাব্য স্থানচ্যুতি এবং সামরিক উপস্থিতির জেরে সেখানে মানবিক বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
জাতিসংঘ, রেড ক্রস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও ত্রাণ সংস্থা ইতিমধ্যেই গাজার মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সেখানে বর্তমানে চরম খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব, স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়া এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুহীন অবস্থায় দিন পার করছেন।
এই অবস্থায় নতুন করে সামরিক অভিযান চালানো ও দখল কার্যক্রম শুরু করলে তা শুধু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকটই নয়, গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের একটি নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে পারে।
নেতানিয়াহু সরকারের ঘোষিত এই পাঁচ মাসব্যাপী সামরিক অভিযান পরিকল্পনা গাজা উপত্যকার ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত হতে পারে। একদিকে সামরিক আধিপত্যের খেলা, অন্যদিকে জিম্মিদের জীবন ঝুঁকি, এবং তার চেয়েও বড় বিষয়—গাজার নিরীহ মানুষের মৌলিক অধিকার ও জীবনযাপনের সুরক্ষা—সবকিছু মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এই পরিকল্পনা একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করতে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক চাপ, কূটনৈতিক সমঝোতা এবং বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ইসরায়েল যদি এই পরিকল্পনায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে আগামি মাসগুলোতে গাজা হয়ে উঠতে পারে মানবিক দুর্যোগের কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাবার্তা/এমএইচ