
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সেনা অভিযান ও দখলদারিত্বের নৃশংসতা যত গভীর হচ্ছে, ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র। সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি এখন মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে ত্রাণ সরবরাহ ব্যবস্থার অরাজকতা ও দুর্বলতা।
সর্বশেষ, মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের কাছে ত্রাণবাহী একটি ট্রাক উল্টে পড়লে মর্মান্তিকভাবে ২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ক্ষুধায় কাতর হয়ে খাদ্য সহায়তার জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই, বুধবার (৬ আগস্ট) প্রকাশিত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা যায়, একদিনেই ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় আরও ১৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭ শতাধিক, যাদের অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
গাজা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নির্দেশে ত্রাণবাহী গাড়িগুলোকে একটি অনিরাপদ ও সংকীর্ণ সড়কপথে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। সে পথ দিয়েই রাফাহ সীমান্ত হয়ে আসা একটি ত্রাণবাহী ট্রাক গন্তব্যে যাচ্ছিল। কিন্তু বিপর্যয় ঘটে তখন, যখন ক্ষুধার্ত ও ত্রাণ প্রত্যাশী হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় ভিড় করে ট্রাকটি ঘিরে ফেলেন। অনেকেই ট্রাকের দিকে দৌড়ে যান, কেউ কেউ উপরে ওঠার চেষ্টা করেন।
এই বিশৃঙ্খলায় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, এবং ট্রাকটি উল্টে পড়ে জনতার ওপরে। মূহূর্তেই হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে বলে জানা গেছে।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পাশাপাশি ইসরাইলি হামলা অব্যাহত রয়েছে গাজার বিভিন্ন স্থানে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বুধবার পর্যন্ত মাত্র একদিনে দখলদার বাহিনীর নির্বিচার হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৩৮ জন ফিলিস্তিনি, যাদের অনেকেই নারী ও শিশু।
আহত হয়েছেন ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে শতাধিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অনেকেই এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন, যাদের উদ্ধার অসম্ভব হয়ে উঠছে অব্যাহত গোলাবর্ষণের কারণে।
চলমান যুদ্ধ ও অবরোধের মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইল কয়েকদিন আগে গাজায় ত্রাণ প্রবেশে অনুমতি দেয়। মিশরের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে, গত দুই সপ্তাহে প্রায় ১ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে।
তবে রেড ক্রিসেন্টের হিসেব অনুযায়ী, গাজায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ প্রয়োজন, অথচ এখনো সেই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছানো যাচ্ছে না।
এছাড়াও তারা অভিযোগ করেছে, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পণ্য প্রবেশে শর্ত জুড়ে দিচ্ছে, যার ফলে বহু জরুরি ত্রাণ সামগ্রী আটকে যাচ্ছে। খাবার, ওষুধ, পানি পরিশোধন সরঞ্জাম—সবকিছুতেই চলছে দমননীতি।
এই মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা পুরোপুরি দখলে নেওয়ার যে পরিকল্পনা করছেন, তা ঘিরে ইসরাইলের অভ্যন্তরেই তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক ও প্রতিবাদ।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ বলেছেন, "গাজায় সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বই নেবে এবং সেনাবাহিনী সেটি বাস্তবায়ন করবে।"
অন্যদিকে, বিরোধী দল ইয়েশ আতিদ নেতা ইয়াইর লাপিদ কড়া ভাষায় এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বলেন, "গাজা দখলের পরিকল্পনা ভয়াবহ ভুল। ইসরাইলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং নাগরিকদের জীবন—সবই এতে ঝুঁকির মুখে পড়বে।"
গাজা দখল ও যুদ্ধ সম্প্রসারণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তেলআবিবসহ ইসরাইলের একাধিক শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা তাদের কাঁধে চাল, ডাল, গমের বস্তা এবং গাজায় ক্ষুধার্ত শিশুদের ছবি বহন করে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
তাদের দাবি, ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধ না করলে ইসরাইলের জিম্মি নাগরিকদের জীবনও হুমকিতে পড়বে, যা এক মানবিক ও কূটনৈতিক বিপর্যয়ে পরিণত হবে।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং কিছু রাষ্ট্র ইসরাইলের এই আগ্রাসন ও ত্রাণের ওপর নিয়ন্ত্রণের কঠোর সমালোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থনে ইসরাইলের কৌশলগত অবস্থান অটল রয়েছে।
এই সমর্থনের জোরে ইসরাইল যুদ্ধ ও দখলের পরিকল্পনা অব্যাহত রেখেছে, যার ফলে গাজার পরিস্থিতি দিন দিন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ