
ছবি: সংগৃহীত
গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, আর সেই প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে ঘিরে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। নির্বাচন, রাজনৈতিক সংস্কার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান জানার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছে দলটি। পাশাপাশি, কূটনীতিকরাও একাধিকবার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা নিচ্ছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। গত ৫ আগস্ট থেকে প্রায় প্রতিদিনই তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যবসায়ী মহলের প্রতিনিধিদের বৈঠক হচ্ছে। এসব বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা, সরকার গঠন হলে দেশ পরিচালনার কৌশল, রাষ্ট্র সংস্কার, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের মতো বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন প্রায় দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দু’দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, যিনি জানিয়েছেন যে আলোচনা ছিল ফলপ্রসূ এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করেছে।
এর আগে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাতারের একজন মন্ত্রী, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক দপ্তরের ইন্দোপ্যাসিফিক বিষয়ক পার্লামেন্টারি আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট, ব্রিটিশ এমপি ক্যাথরিন ওয়েস্ট, ব্রিটিশ কনজারভেটিভ দলের গবেষণা উন্নয়নবিষয়ক সাবেক পরিচালক রজ ক্যাম্পসেল, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসসহ আরও অনেকে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের পর বিএনপি একটি সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্ব পেয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, বিদেশিরা ভাবছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির জয় সম্ভাব্য। তাই বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নীতি কেমন হবে—তা বোঝার জন্যই তারা সরাসরি যোগাযোগ করছেন। তিনি এটিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদও একমত হয়ে বলেছেন, তারেক রহমান বর্তমানে একটি বড় দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, তবে তিনি আরও বড় রাজনৈতিক নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছাবেন। ফলে বিদেশিদের আগ্রহ স্বাভাবিক।
বিএনপি ইতিমধ্যেই ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন, স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা। বিদেশি কূটনীতিকরা এ পরিকল্পনা সম্পর্কে গভীর আগ্রহ দেখাচ্ছেন এবং তারেক রহমান তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছেন।
শুধু লন্ডনেই নয়, ঢাকায়ও বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। গত এক বছরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, সৌদি আরবসহ ২২টি দেশের কূটনীতিক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন, বিনিয়োগ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও নতুন সরকারের সঙ্গে কাজের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বিদেশি কূটনীতিকদের সৌজন্য সাক্ষাৎ অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ২১ জুলাই ভুটানের রাষ্ট্রদূত দাশো খারমা হামু দর্জি গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়ে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক প্রতিনিধিদল চীন সফর করেছে। সর্বশেষ গত জুনে নয় সদস্যের একটি দল, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে, চীন সফরে গিয়ে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করেছে। মির্জা ফখরুল বলেছেন, এই সফর ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে জেনে সবার মধ্যে স্বস্তি ও আশা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ ফিরবে—এটাই সবার প্রত্যাশা। নির্বাচিত সরকারের কর্মকাণ্ডই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে, যা দেশি-বিদেশি সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপিকে ঘিরে এই কূটনৈতিক তৎপরতা কেবল একটি নির্বাচনকেন্দ্রিক আগ্রহ নয়, বরং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ