
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পার হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত ৫ আগস্ট থেকে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং পরবর্তীতে বাহিনীর ঢেলে সাজানোর পর কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরলেও, তা এখনও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার উচ্চতায় পৌঁছায়নি। দেশে কিশোর গ্যাং, ছিনতাই, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, মব ভায়োলেন্সসহ নানা অপরাধ প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ সদস্যরাও মাঝে মাঝে হামলার শিকার হচ্ছেন।
গত ১০ মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫) দেশে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টি মামলা হয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সংকটের দিকে দৃষ্টিপাত করায় উদ্বেগ তৈরি করেছে। এর মধ্যে খুন, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ গুরুতর অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
সম্প্রতি রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের নির্মম হত্যার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর তার মরদেহের উপর দিয়ে উল্লাস করে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় সামাজিক অস্থিরতা তীব্র হয়েছে।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, আগের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অনেক উন্নতি হয়েছে এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের তৎপরতাও জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অপরাধী গ্রেফতারের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও মানবাধিকার সংস্থা এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৪১টি ধর্ষণ ও ৮৭টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। মব ভায়োলেন্সে ৮৯টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অধিকাংশ ঢাকা বিভাগে সংঘটিত হয়েছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গড়ে প্রতিদিন ১১টি খুনের মামলা হচ্ছে। গত এক বছরে মোট খুনের মামলা ৩,৮৩২টি। এর মধ্যে ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ১,৯৩৩টি খুনের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে, যা আগের ছয় মাসের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। মব সন্ত্রাস, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের অপ্রতুলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশ কার্যক্রমে সংকট দেখা দিয়েছে। আইন প্রয়োগে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে।” তিনি আরও বলেন, “পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, যা তাদের নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা পালনে বাধা সৃষ্টি করে।”
অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) ২ আগস্ট বলেছেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে। পুলিশ অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে এবং মব সহিংসতা কমেছে। সাংবাদিকদের সহযোগিতা পেলে পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে।”
সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশন্স পরিচালক কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানালেন, “মাদক ও চাঁদাবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫,৫৭৬ জন গ্রেফতার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি একসঙ্গে কাজ করে, তবে অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।”
তবে জনগণের অনুভূতি এবং বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, এখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘সন্তোষজনক’ স্তরে পৌঁছায়নি। বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থানের সময় নির্বিচারে গুলি চালানো, অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা না হওয়া বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তদন্ত ও বিচার ব্যাহত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, “বিগত এক বছরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলার তদন্ত এগিয়ে এসেছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চেকপোস্ট স্থাপন করে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।”
আসলে, বর্তমান সরকারের উদ্যোগেই বিগত কয়েক বছর ধরেই অবহেলিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও গুম-অপহরণের ভুক্তভোগীরা মামলা করার সুযোগ পেয়েছেন, যার ফলে মামলার পরিমাণ বেড়েছে। এটি সামগ্রিকভাবে অপরাধবৃদ্ধির ইঙ্গিত নয় বরং পূর্বের অপরাধের সুষ্ঠু হিসাব-নিকাশ শুরু হওয়ার বহিঃপ্রকাশ।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সংগঠনও সরকারের কাছে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তৎপরতা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে আসছে। নিরাপত্তার অভাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য সমাজের সর্বস্তরের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা বিশেষজ্ঞরা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
সরকারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। তবে সংশ্লিষ্ট সকলেই আশাবাদী, একযোগে কাজ করলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শিগগিরই আরও উন্নতির দিকে যাবে এবং নাগরিকরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে পারবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ