
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল দীর্ঘদিন ধরেই মাঠের সাফল্য ও সম্ভাবনা দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করে আসছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বারবার গৌরব অর্জন করলেও, প্রশাসনিক সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং খেলোয়াড়দের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো তারা পুরুষ দলের সমান মর্যাদা পাননি। সাম্প্রতিক দুইটি ঘটনা এই বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে—একটি ঘটেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দিক থেকে, আরেকটি ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) পক্ষ থেকে।
গত এপ্রিলে আইসিসি নারী বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিগার সুলতানা জ্যোতির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ নারী দল দেশের জন্য এক বড় অর্জন নিয়ে আসে। কিন্তু বিসিবি এই সাফল্যের পরও তাদের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক প্রস্তুতি সিরিজ আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে আগামী মাসে ভারত বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাওয়ার আগে এই দল একটিও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে না।
প্রস্তুতির অভাব কাটাতে বিসিবি এই মাসে বিকেএসপিতে নারী দলের জন্য অনূর্ধ্ব-১৫ পুরুষ দলের বিপক্ষে কয়েকটি অনুশীলন ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের প্রস্তুতি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য যথেষ্ট নয়।
একই সময়ে, দেশের পেশাদার ক্রিকেটারদের স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠন কোয়াব আসন্ন ৪ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের আগে একাধিক সভা করেছে, যেখানে প্রাক্তন ও বর্তমান বহু পুরুষ ক্রিকেটার উপস্থিত থাকলেও একজন নারী ক্রিকেটারকেও দেখা যায়নি। এই অনুপস্থিতি কেবল কাকতালীয় নয়, বরং আমন্ত্রণের অভাবের ফল—এমনটাই জানিয়েছেন নারী দলের সিনিয়র সদস্যরা।
নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি নিজের ফেসবুক পোস্টে স্পষ্ট ভাষায় এই অবহেলা তুলে ধরেন। তিনি লেখেন— "একজন ক্রিকেটার এবং একজন নারী ক্রিকেটারের মধ্যে পার্থক্য আছে, বন্ধু।"
এরপর অলরাউন্ডার রুমানা আহমেদ আরও বিশদভাবে তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। রুমানা জানান, কোয়াবের কোনো মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ তাঁরা কখনো পাননি। কয়েক দিন আগে কোয়াবের একটি অনুষ্ঠানের খবর পেলেও, সেখানেও নারী ক্রিকেটারদের ডাকা হয়নি।
তিনি প্রশ্ন তোলেন— "কোয়াব আমাদের জন্য কাজ করে কি না, সেটা নিয়েই এখন সন্দেহ হচ্ছে। আমাদের গুরুত্ব কোথায়?"
রুমানা আরও জানান, তিনি এমনকি নিশ্চিত নন যে আসন্ন নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগও পাবেন কি না।
কোয়াবের আহ্বায়ক সেলিম শাহেদ জানান, বিসিবির চুক্তিভুক্ত যেকোনো ক্রিকেটার বার্ষিক ফি প্রদান করে স্থায়ী সদস্য হতে পারেন এবং তাতে ভোটাধিকারও পাবেন। নারী ক্রিকেটাররা চাইলে ১ লাখ টাকা এককালীন ফি দিয়ে আজীবন সদস্যপদও নিতে পারবেন।
এদিকে জাতীয় দলের ক্রিকেটার মোহাম্মদ মিঠুন এই ক্ষোভকে "ভুল বোঝাবুঝি" বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর দাবি—এই সভাগুলো ছিল অ্যাড-হক কমিটির উদ্যোগে, যেখানে অনেককেই আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগ দিয়েছেন, তাই নারী ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতি ইচ্ছাকৃত ছিল না।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো পুরুষ ও নারী ক্রিকেটারদের একই ম্যাচ ফি দিয়ে থাকে। অন্যান্য দেশও ধীরে ধীরে এই সমতার পথে হাঁটছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পুরুষ ও নারী ক্রিকেটের বেতন ব্যবধান বিশাল, এবং সেটি কমানোর কোনো কার্যকর পরিকল্পনাও দৃশ্যমান নয়।
বাংলাদেশ নারী দল ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন—একটি সাফল্য যা এখনো পুরুষ দল অর্জন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও, নারী ক্রিকেটারদের সুযোগ-সুবিধা, প্রশিক্ষণ অবকাঠামো এবং সম্মানজনক আচরণের ক্ষেত্রে ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে।
এই ঘটনা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং সমান মর্যাদা ও সম্মানের জন্য এক দৃঢ় দাবি। দেশের ক্রিকেট প্রশাসক ও সংগঠনগুলোর জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা—যদি অবহেলা ও বৈষম্য চলতে থাকে, তবে প্রতিভাবান নারী ক্রিকেটাররা মনোবল হারাতে পারেন, যা দেশের ক্রিকেটের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ