
ছবি: সংগৃহীত
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে বেসরকারি ডিপোগুলোতে রপ্তানি পণ্যের ব্যাপক জটিলতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে অবস্থিত ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে প্রায় ১৫ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট সমমান) রপ্তানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার আটকা রয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ডিপোগুলোতে প্রতিদিন সাধারণত ৭ থেকে ৮ হাজার কনটেইনার থাকার কথা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই অস্বাভাবিক অবস্থা মূলত বন্দরে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় বেড়ে যাওয়া এবং রপ্তানি পণ্যের চাপ বৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্দরে আটকে থাকা কনটেইনারগুলো ডিপোতে পড়ে থাকার ফলে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পের রপ্তানি কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)-র মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার জানান, “গত জুলাই মাসে ডিপোগুলোতে অন্যান্য মাসের তুলনায় রপ্তানি পণ্যের চাপ অনেক বেশি ছিল। যেখানে স্বাভাবিক সময় গড়ে প্রতি মাসে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হতো, সেখানে জুলাই মাসে ৮১ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। আগস্ট মাসেও এই চাপ অব্যাহত রয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “বর্তমানে বন্দরে জাহাজের গড় অপেক্ষমাণ সময় আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। একটি জাহাজ বার্থিং পেয়ে আমদানি কনটেইনার খালাস করতে কয়েক দিন সময় নিচ্ছে। এরপর রপ্তানি কনটেইনার নিয়ে সেই জাহাজ বন্দর ত্যাগ করছে। এর ফলে পণ্য জাহাজীকরণে অতিরিক্ত সময় লেগে যাচ্ছে এবং কনটেইনারগুলো দীর্ঘ সময় ডিপোতেই পড়ে থাকে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন প্রশাসনের গত ৮ জুলাই বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর থেকে এই সমস্যা আরও জটিল রূপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অতিরিক্ত শুল্ক এড়াতে দ্রুত পণ্য শিপমেন্টের জন্য বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন, যার প্রেক্ষিতে রপ্তানিকারকরা নির্ধারিত সময়ের আগেই ডিপোগুলোতে পণ্য পাঠানো শুরু করেছেন।
তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী বিজিএমইএর পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী জানান, “ডিপোর বাইরে শত শত ট্রাক পণ্য নিয়ে অপেক্ষমাণ রয়েছে, কিন্তু ডিপোর মধ্যে পণ্য নামিয়ে রাখার জায়গা নেই। এর ফলে প্রতিদিন ট্রাক ভাড়া কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। ডিপোর ভেতরও প্রচুর পরিমাণ রপ্তানি পণ্য পড়ে রয়েছে, যা যথাসময়ে জাহাজে তোলা না হলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে তাদের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে যা ভবিষ্যতে রপ্তানি শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।”
তিনি বলেন, “এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য বন্দরে রপ্তানির গতি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ডিপোগুলোতে পণ্য স্টাফিংয়ের কাজ দ্রুত ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে এবং ডিপোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন জটিলতা আর না হয়।”
বন্দর কর্তৃপক্ষও জানায়, বন্দরে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় কমাতে এবং পণ্যের জটিলতা দূর করতে তারা একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। চেকপোস্ট ও টার্মিনাল ব্যবস্থার উন্নতি, পোর্ট অপারেশন আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি রপ্তানির গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য দ্রুত এবং সময়মত পণ্য পরিবহন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বন্দরে অব্যবস্থাপনা ও ডিপোগুলোতে জটিলতা দ্রুত সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
ডিপো ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সকলের যৌথ উদ্যোগ ছাড়া এই জটিলতা কাটানো সম্ভব নয়। দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষ, ডিপো মালিক ও রপ্তানিকারকরা একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিকভাবে, চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি পণ্য জটিলতা দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা নিরসনে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন, যাতে রপ্তানি সেক্টর আগামীর বাজারে প্রতিযোগিতামূলক ও স্থায়ী অবস্থান ধরে রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ