
ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়া অবশেষে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। আগামী মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে দেশটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সোমবার (১১ আগস্ট) ক্যানবেরায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ এ তথ্য জানান। এই ঘোষণার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতিকে স্পষ্ট সমর্থন জানাল।
প্রধানমন্ত্রী আলবানিজের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গাজায় চলমান যুদ্ধ, মানবিক বিপর্যয় ও সহিংসতার অবসানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আলবানিজ বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতার চক্র ভাঙতে এবং গাজায় সংঘাত, দুর্ভোগ ও অনাহার শেষ করতে দুই রাষ্ট্র সমাধানই মানবতার জন্য সর্বোত্তম আশা। যতদিন পর্যন্ত পৃথক ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা স্থায়ী রূপ না নিচ্ছে, ততদিন শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসবে না।”
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কিছু প্রভাবশালী দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডা ইতোমধ্যেই সেপ্টেম্বরের জাতিসংঘ সম্মেলনে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এখন তাদের কাতারে যুক্ত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াও। আলবানিজ জানান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকারকে বাস্তবে রূপ দিতে চায়।
গাজায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও অবরোধের ফলে ২০ লাখ মানুষের জীবন চরম সংকটে পড়েছে। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনার ব্যর্থতার পর থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধানকে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানান, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাকে স্পষ্টভাবে আশ্বস্ত করেছে যে ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে হামাসের কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ভূমিকা থাকবে না। এই প্রতিশ্রুতিই ক্যানবেরার সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যদিও বাস্তব পরিস্থিতিতে গাজায় মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; প্রায় দুই দশক ধরে গাজার শাসনভার রয়েছে সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হাতে।
অস্ট্রেলিয়ার ঘোষণার কিছু ঘণ্টা আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক মহলে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচেষ্টার কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “এতে শান্তি আসবে না, বরং আরও যুদ্ধের পথ খুলে যাবে।” ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও অস্ট্রেলিয়ার পরিকল্পনাকে তিনি “হতাশাজনক ও লজ্জাজনক” বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলবানিজ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেন, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করছে এবং গাজায় পর্যাপ্ত ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না। তিনি মনে করেন, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্তের পর নিউজিল্যান্ডও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স বলেন, “স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি হবে না— সে প্রশ্ন নেই, কেবল সময়ের ব্যাপার।”
ইতোমধ্যেই আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের ধারা দ্রুত শক্তিশালী হচ্ছে, যা কূটনৈতিক চাপ বাড়াবে ইসরায়েলের ওপর।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলমান সংঘাতে এখন পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছেন ৬১ হাজার ৪৩০ জন ফিলিস্তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় খাবার, ওষুধ ও নিরাপদ আশ্রয়ের তীব্র সংকট চলছে। বেইত লাহিয়ায় ত্রাণ নিতে যাওয়া মানুষের ওপর ইসরায়েলি সেনার গুলিতে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
এই ঘোষণার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া কেবল একটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিল না, বরং মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দিল— শান্তির সমাধান হলো দুই রাষ্ট্র, যেখানে ফিলিস্তিনেরও থাকবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সার্বভৌমত্ব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ