
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের নিটওয়্যার কেন্দ্র তিরুপ্পুরসহ দক্ষিণ ভারতের গার্মেন্টস শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিরাট ধাক্কা খাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ৫০ শতাংশ শুল্কের ফলে মার্কিন ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত হচ্ছে বা সরাসরি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের মতো কম শুল্কযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে সরে যাচ্ছে। এতে তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর ও করু অঞ্চলের প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খাচ্ছে।
তিরুপ্পুরের গার্মেন্টস রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, মার্কিন ক্রেতারা আগের ২৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর চাপ বহন করতে বাধ্য হলেও এখন তা এক লাফে ৫০ শতাংশে ওঠায় অনেক অর্ডার স্থগিত রাখা বা বাতিল করে দিচ্ছে। এক রপ্তানিকারক জানালেন, তার নিয়মিত মার্কিন চালান পাকিস্তানে চলে গেছে, যেখানে শুল্ক হার তুলনামূলক কম। অন্যরা বলছেন, মার্কিন ক্রেতারা গ্রীষ্মকালীন অর্ডার নিশ্চিতের আগে ‘অপেক্ষা করতে’ বলছেন।
তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম সুব্রামানিয়ান বলেন, “এটি একটি বিশাল ধাক্কা। আমাদের মুনাফা মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ, আর শুল্কের বোঝা বহন করাটা কঠিন। বহু ক্রেতা ইতোমধ্যেই আমাদের পণ্যের বদলে সস্তা বিকল্প খুঁজছে।” তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ, যাদের শুল্কহার মাত্র ২০ শতাংশ, ফলে তারা অনেক সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তিরুপ্পুর, করু ও কোয়েম্বাটুর—দক্ষিণ ভারতের তিন বাণিজ্যকেন্দ্রে গার্মেন্টস রপ্তানির অবস্থা সংকটজনক হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমে গেলে এক থেকে দুই লাখ শ্রমিকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধুমাত্র তিরুপ্পুরেই বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি রুপির নিটওয়্যার রপ্তানি হয়।
শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব শুধু পোশাক খাতেই সীমাবদ্ধ নয়; গৃহস্থালি টেক্সটাইলের জন্য পরিচিত কোয়েম্বাটুর ও করুতেও মার্কিন অর্ডার স্থবির হয়ে পড়েছে। সাউদার্ন ইন্ডিয়া মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কে সেলভারাজু জানান, তারা ইতিমধ্যেই অনেক অর্ডারের বুকিং পিছিয়ে পেয়েছেন, যা পুরো সিজন হারানোর ঝুঁকি তৈরি করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতীয় তুলার ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক, সুতোতে ১২ শতাংশ, পলিয়েস্টার কাঁচামালে ১৮ শতাংশ কর এবং তৈরি পোশাকে ৫ শতাংশ কর এই খাতকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় ভারতের কর কাঠামো কঠিন, যা রপ্তানি খরচ বাড়াচ্ছে।
এ বছর ব্রাজিল থেকে আমদানি হওয়া তুলার ৪৫ শতাংশের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সেলভারাজু, যেন তারা তুলাকেন্দ্রিক বিশেষ চুক্তি করতে পারেন যাতে মার্কিন তুলার শুল্কমুক্ত আমদানি সম্ভব হয় এবং সেখান থেকে তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা যায়।
বিশ্ববাজারে ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই ধরনের কঠোর শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছেন না। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার ৩৫-৩৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৯-২১ শতাংশ, ভিয়েতনামে ২০-২১ শতাংশ, এবং কম্বোডিয়ায় আগের ৪৯ শতাংশ থেকে বর্তমানে মাত্র ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। তাই মার্কিন বাজারে ভারতের জন্য ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা একেবারেই আলাদা ও বিশাল চ্যালেঞ্জ।
শিল্প নেতারা বলছেন, মহামারির সময় কেন্দ্রীয় সরকার যে অর্থায়ন ও সহায়তা দিয়েছিল, তার পুনরায় প্রয়োজন এখন। সেলভারাজু উল্লেখ করেন, তুলার ওপর আমদানি শুল্ক বাতিল ও কৃত্রিম তন্তুর ওপর জিএসটি পুনর্গঠন ছাড়া ভারতীয় গার্মেন্টস খাত টিকে থাকতে পারবে না।
তিনি বলেন, “মার্কিন ক্রেতারা এখনও ভারতীয় তুলা ও পোশাক পছন্দ করেন, তবে রাজনৈতিক ও নীতিগত বাধার কারণে তারা এখন আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদী হলে আমরা স্থায়ীভাবে মার্কিন বাজার হারাতে পারি।”
তিরুপ্পুরের অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, আগামী দুই-তিন সপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় হবে। অর্ডার এখনও পুরোপুরি বাতিল হয়নি, তবে ক্রেতাদের মনোভাব পরিবর্তিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য আশংকা বাড়াচ্ছে।
বর্তমানে ভারতের গার্মেন্টস খাত বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ মার্কিন বাজারে ভারতের অবস্থান দুর্বল করে দিচ্ছে এবং বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ প্রতিবেশী দেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করছে। এর ফলে ব্যবসার সংকট, উৎপাদন কমে যাওয়া ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সংকট দেখা দিতে পারে।
সরকার দ্রুত উপযুক্ত নীতি গ্রহণ না করলে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চল তিরুপ্পুরসহ সারা দেশের গার্মেন্টস শিল্প বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করছেন।
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
বাংলাবার্তা/এমএইচ