
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং হত্যার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে দেশে মোট ২৫৯ শিশু নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এ তথ্য প্রকাশ করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। পাশাপাশি শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা গত বছরের তুলনায় ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ১০৯৮ নম্বর চাইল্ড হেল্পলাইনে ২০২৪ সালের প্রথম সাত মাসে শিশুরা অথবা তাদের অভিভাবকরা ২৬ হাজার ১০০টি সহায়তা চাওয়া কল করেছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাত হাজার বেশি। এই হেল্পলাইনে শিশু নির্যাতন, আইনি সহায়তা, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা, স্কুল-সম্পর্কিত বিষয়সহ নানা ধরনের সহায়তার জন্য কল আসছে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই এই হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালে এখানে শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত কল ছিল মাত্র ৮ হাজার ২১টি, যা ২০২৩ সালে দ্বিগুণ হয়ে ১৫ হাজার ৭৮৫ এ উন্নীত হয়। ২০২৪ সালে তা আবার প্রায় চার হাজার বাড়িয়ে ২৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৪০ শিশু, যা গত বছরের ৪৬৩ জনের থেকে অনেক বেশি। ধর্ষণের শিকার শিশুদের সংখ্যা ৩০৬ জন, যা আগের বছরের ১৭৫ জনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
অন্যদিকে, সাত মাসে ২৫৯ শিশু নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৪ জন। শারীরিক নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৫ জন, আর নিখোঁজ থাকার পর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে ৩৫ শিশুর। আগের বছর একই সময়ে শিশু হত্যা হয়েছিল ৩২৫ জনের। তবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহত শিশুরা এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত নয়।
গণমাধ্যমে দেখা ২০টি খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৬টি ঘটনা আপনজনের হাতে ঘটেছে। মা-বাবা, সৎমা, আত্মীয়, প্রতিবেশী এবং দুর্বৃত্তদের হাতে শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে। পারিবারিক কলহ, মানসিক চাপ এবং অভিভাবকদের মধ্যকার মতবিরোধের কারণে শিশুদের ওপর সহিংসতা বাড়ছে।
বেশ কয়েকটি নৃশংস হত্যা-কাণ্ডের উদাহরণ তুলে ধরা হয়, যেখানে পরিবারের সদস্যদের হাতে শিশুর প্রাণ গেছে। যেমন ময়মনসিংহে একটি পরিবারে মা ও দুই শিশু কুপিয়ে হত্যা, মাগুরায় আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা, মুন্সীগঞ্জে মা নিজ সন্তানদের হত্যা, রাজধানীতে মা নিজ মেয়েকে হত্যা করা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের পর হত্যা এবং সিরাজগঞ্জে সৎমায়ের হাতে শিশুর খুনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
শিশুদের নির্যাতন ও হত্যার কারণ হিসেবে পারিবারিক অস্থিরতা, হতাশা, মানসিক অসুস্থতা, মাদকাসক্তি ও দাম্পত্য সমস্যা বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ‘পরিবারের ভেতরে মা-বাবার সম্পর্কের টানাপোড়েন ও মানসিক চাপ শিশুর ওপর সহিংসতার জন্য প্রধান কারণ।’
আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুধুমাত্র আইনগত ব্যর্থতা নয়, বরং সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। এটি গভীর উদ্বেগের বিষয় এবং দ্রুত কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়রুল চৌধুরী জানান, ‘বাংলাদেশে মানুষের নৈতিক শক্তি আগের মতো নেই। সহিংসতা, দুর্নীতি ও সামাজিক অস্থিরতা শিশুদের নিরাপত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্রের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা ও জনগণকে সচেতন করতে হবে।’
শিশুদের ওপর সহিংসতা ও হত্যার হার বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে সমাজের নৈতিক অবক্ষয়। পারিবারিক কলহ, মানসিক চাপ, আর্থিক সংকট ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা শিশুদের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি, পরিবারে ভালোবাসা ও সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি, এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুদের জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত আইনগত ও সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ