
ছবি: সংগৃহীত
দেশের পেঁয়াজের বাজারে আবারও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। মৌসুম শেষ, আমদানি বন্ধ এবং টানা বর্ষণের কারণে সরবরাহে ঘাটতির অজুহাত তুলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৩০-৩৫ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও বাস্তবে বাজারে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে, তবুও সিন্ডিকেটের প্রভাবে পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়ে হু হু করে বাড়ছে দাম।
বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ৩১ জুলাই রাজধানীর খুচরা বাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৫৫ টাকা। মাত্র একদিন পর ১ আগস্ট দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ টাকায়। কিন্তু সেখানেই থামেনি; ৮ আগস্ট শুক্রবারে খুচরায় পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮৫ টাকায়, আর রোববার তা গিয়ে ঠেকে কেজিপ্রতি ৯০ টাকায়। অর্থাৎ ১০ দিনের মধ্যে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩৫ টাকা।
সাইদুর রহমান নামে এক ভোক্তা বলেন, “নিত্যপণ্যের বাজারে এই অরাজকতা চলছে কমপক্ষে ১৫-২০ বছর ধরে। পুরনো সেই সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়, তাই ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেয়। পাইকারি বা খুচরা—কোথাও সংকট নেই, তবুও ভোক্তাকে বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে।”
রোববার রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি আড়ত ঘুরে জানা গেছে, প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৬০ টাকায়, যা কেজিপ্রতি ৬৮-৭২ টাকা। মাত্র এক সপ্তাহ আগে এই দাম ছিল ২৫০ টাকা পাল্লাপ্রতি (৫০ টাকা কেজি)। অর্থাৎ এক সপ্তাহে পাইকারি পর্যায়ে পাল্লাপ্রতি ৯০-১১০ টাকা, কেজিপ্রতি ১৮-২২ টাকা বেড়েছে।
কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ, রামপুরা—রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে রোববার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০ টাকা এবং দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৫৫ টাকা।
নয়াবাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. আল আমিন জানান, দুই সপ্তাহ আগে থেকেই আড়তদাররা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। বৃষ্টির কারণে সরবরাহে ঘাটতির অজুহাত দিচ্ছেন, যদিও আড়তে পর্যাপ্ত মজুত আছে। তিনি বলেন, “প্রত্যেক আড়তে বস্তাভর্তি পেঁয়াজ সাজানো, ঘাটতি নেই। কিন্তু দামের কারসাজি হচ্ছে।”
চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে গত সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের বাজার অস্থির। ভালোমানের দেশি পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৫-৫৮ টাকা। খুচরায় একই মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। মাঝারি মানের পেঁয়াজ পাইকারিতে ৬৭-৬৮ টাকা (১৫ দিন আগে ছিল ৫০ টাকা), আর খুচরায় ৭৫-৭৮ টাকা।
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস জানান, “যেহেতু বিদেশ থেকে আমদানি নেই, পুরোপুরি দেশি পেঁয়াজের ওপর নির্ভর করছে বাজার। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় সপ্তাহে কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। কৃষকের সংরক্ষিত পুরোনো পেঁয়াজও এখন বাজারে ছাড়া হচ্ছে। নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ এলেই দাম কমবে।”
আড়তদাররা জানিয়েছেন, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গ থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ আসছে। ভারি বর্ষণের কারণে মোকামগুলোতে সরবরাহ কমে গেছে, যার ফলে কেজিপ্রতি ১০-১২ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ট্রাক ভাড়া এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধিও দাম বাড়ার আরেকটি কারণ।
ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “প্রতিবছর একই কায়দায় অসাধু ব্যবসায়ী পেঁয়াজের দাম বাড়ান। কিন্তু কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। বাজার তদারকির জন্য কোনো গবেষণাও নেই। ফলে বছরের পর বছর ভোক্তা অস্বস্তিতে থাকে।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পেঁয়াজের দাম সহনীয় রাখতে তিন স্তরে—কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে—তদারকি চলছে। প্রতিটি স্তরে পেঁয়াজ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্যাশ মেমো রাখতে বলা হয়েছে। এতে বোঝা যাবে কোথায় দাম বাড়ানো হচ্ছে। অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমদানি সচল রাখার সুপারিশ করা হবে।
এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দিচ্ছে, দেশের পেঁয়াজ বাজার আবারও পুরনো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও সরবরাহ সংকটের অজুহাত তুলে দাম বাড়ানো হচ্ছে, যা সরাসরি ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। যতদিন না কঠোর নজরদারি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর হবে, ততদিন এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি মিলবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ