
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার ব্যস্ত পলাশী মোড়ে দায়িত্ব পালনরত এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগে সহকারী কর কমিশনার ফাতেমা বেগমকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন আইআরডি রবিবার (১০ আগস্ট) আনুষ্ঠানিকভাবে এ সংক্রান্ত বরখাস্তের আদেশ জারি করে।
আদেশটি জারি করেছেন আইআরডি সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ফাতেমা বেগম কর অঞ্চল-২৫ এ সহকারী কর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পর সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮–এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী অসদাচরণের শামিল বলে বিবেচিত হয়েছে। সেই কারণে বিভাগীয় শাস্তিমূলক কার্যধারা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়ে বিধি অনুসারে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের মেয়াদকালে তিনি প্রযোজ্য নিয়মে খোরপোশ ভাতা পাবেন।
আইআরডি ও ঢাকা মহানগর পুলিশের নথি অনুযায়ী, ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ১২ এপ্রিল রাতে, আনুমানিক রাত ৮টার দিকে। সেদিন ফাতেমা বেগম ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা মেট্রো–গ ৩৪–৫৯০৬ নম্বরের একটি প্রাইভেট কারে করে পলাশী মোড়ে অবস্থান করছিলেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট শাহা জামাল। নিয়মিত তল্লাশির অংশ হিসেবে সার্জেন্ট গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চান।
ফাতেমা বেগম তখন জানান, তার গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে। তবে তিনি কোনো কাগজপত্র দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সার্জেন্ট শাহা জামাল দ্বিতীয়বার কাগজপত্র প্রদর্শনের অনুরোধ করলে ফাতেমা বেগম গাড়ি থেকে নেমে এসে ক্ষুব্ধ হয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, ওই সময় তিনি সার্জেন্টকে উদ্দেশ করে একাধিক অবমাননাকর ও ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন, যেমন— “ছোটলোকের বাচ্চা”, “ফকিন্নির বাচ্চা” এবং “সারা জীবন ঘুষ খাইছে”। এসব মন্তব্যকে শুধু অসৌজন্যমূলক নয়, বরং পেশাগত মর্যাদার প্রতি চরম অবমাননা হিসেবে দেখা হয়।
ঘটনার পরই ট্রাফিক সার্জেন্ট শাহা জামাল লালবাগ থানায় ফাতেমা বেগমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ঘটনাস্থলের সময়, পরিস্থিতি, ব্যবহৃত ভাষা এবং আচরণের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়, একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ফাতেমা বেগমের আচরণ শৃঙ্খলাবিধি লঙ্ঘন করেছে এবং রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মচারীর মর্যাদার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
মামলার পর বিষয়টি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে পৌঁছায়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, অভিযোগের যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে। বিশেষ করে ঘটনাটি জনসম্মুখে ঘটায় সরকারি সেবাখাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করে আইআরডি।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮–এর ৩(খ) ধারা অনুসারে অসদাচরণের শাস্তি হিসেবে বিভাগীয় কার্যধারা শুরুর আগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার ক্ষমতা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। সেই ধারার আওতায় আইআরডি ফাতেমা বেগমকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
আদেশে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি পূর্ণ বেতন পাবেন না; বরং বিধি অনুযায়ী খোরপোশ ভাতা প্রদান করা হবে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চলমান বিভাগীয় তদন্ত শেষ হলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এ ধরনের আচরণ সরকারি সেবার মান ও সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আবার কেউ কেউ বলছেন, কর্মকর্তাদের আচরণবিধি ও জনসেবার সময় ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে আরও কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
এদিকে ট্রাফিক পুলিশ সূত্র বলছে, রাজধানীতে প্রতিদিন অসংখ্য গাড়ি তল্লাশি করা হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চালক ও যাত্রীরা সহযোগিতা করেন। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা হয়েও কেউ যদি নিয়ম মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে উল্টো অশালীন আচরণ করেন, তবে তা শৃঙ্খলাভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত এবং আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করি সবাই শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণ করবেন। এখানে ব্যক্তিগত অপমান ও পেশাগত অসম্মান—দুটোই ঘটেছে। তাই প্রাথমিকভাবে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তদন্ত শেষে চূড়ান্ত শাস্তি নির্ধারণ হবে।”
সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধি অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের অসদাচরণ বা শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকরিচ্যুতি, পদাবনতি, বেতন কর্তনসহ বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। এখন নজর থাকবে, ফাতেমা বেগমের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত শেষে চূড়ান্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় আইআরডি।
বাংলাবার্তা/এসজে