
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের আগস্টে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তখন দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ছিল মারাত্মক চাপের মুখে—প্রবৃদ্ধি কমছিল, মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই অঙ্কে অবস্থান করছিল, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত খরচ হয়ে যাচ্ছিল, ব্যাংকিং খাত তারল্য সংকটে ভুগছিল, জ্বালানি খাতে বৈদেশিক দেনা বাড়ছিল, আর রাজস্ব আদায় পিছিয়ে পড়েছিল লক্ষ্য থেকে।
এক বছর পর, আগস্ট ২০২৫-এ এসে চিত্র কিছুটা বদলেছে। সংকট পুরোপুরি কেটে না গেলেও অবনতি অন্তত থেমেছে, এবং অনেক সূচকে আভাস মিলেছে পুনরুদ্ধারের। তবে একইসঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে, কাঠামোগত সংস্কারের পথে যাত্রা এখনও শুরুই হয়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক আগে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছিল ১২ শতাংশে। এর আগের সাত মাসের মধ্যে ছয় মাসই ছিল দুই অঙ্কের ঘরে, আর প্রায় তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপরে। একই সময়ে রিজার্ভ নামতে নামতে আইএমএফের বিপিএম৬ মানদণ্ডে ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে আসে। ব্যাংকগুলো আমদানি দায় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল, ডলার বাজার ছিল অস্থিতিশীল, আর ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিল প্রবল অনিশ্চয়তা।
সালেহউদ্দিন আহমেদ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে স্মরণ করিয়ে দেন— “আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় অবস্থা ছিল খুবই অনিশ্চিত। এখন অন্তত বলা যায়, পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল। রিজার্ভ বাড়ছে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি দুই-ই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে, বিনিময় হারও উন্মুক্ত করার পর স্থিতিশীল রয়ে গেছে।”
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মুদ্রানীতিকে কঠোর করে, আইএমএফ নির্দেশনার অপেক্ষা না করে একাধিকবার নীতি সুদহার বাড়ায় এবং বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিকভাবে সমন্বয় করে। একইসঙ্গে উন্নয়ন ব্যয় সংকুচিত করা হয়, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সামঞ্জস্য করা হয়।
ফলাফল হিসেবে:
রেমিট্যান্স: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৬.৪৬% প্রবৃদ্ধি, দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠেছে।
রপ্তানি: ৮.৫৮% বেড়েছে, যেখানে আগের বছর প্রায় ৬% হ্রাস পেয়েছিল।
রিজার্ভ: জুন ২০২৫-এ দাঁড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৩২ বিলিয়ন ডলার, বিপিএম৬ মানদণ্ডে ২৭ বিলিয়ন ডলার।
মূল্যস্ফীতি: জুন ২০২৫-এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট হার তিন বছরের মধ্যে প্রথমবার ৯%-এর নিচে নেমে আসে।
অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমানের বিশ্লেষণ— “মূল্যস্ফীতি কমানো ও রিজার্ভ স্থিতিশীল করা—এ দুটি ক্ষেত্রে সরকার সফল হয়েছে। তবে এটা মূলত অবনতির ধারা থামানো, উল্টোদিকে ঘোরানো নয়। খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ দাম এখনও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কষ্টকর।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২.২৩%—আগের বছরের ১৫% প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম। লক্ষ্য থেকে ঘাটতি ছিল ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম নিম্নতম পর্যায়ে রয়ে গেছে।
এ অবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার হিসেবে নেওয়া হয় কর ও শুল্ক বিভাগকে আলাদা করার পদক্ষেপ। অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও অর্থ উপদেষ্টা এতে অনড় থাকেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেন— “এনবিআরকে আলাদা করা সাহসী সিদ্ধান্ত। বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার পিছু হটেনি—এটি সংস্কার বাস্তবায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।”
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি জুন ২০২৫-এ দাঁড়ায় মাত্র ৬.৪%—যা একটি প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতির জন্য খুবই কম। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা ২৫% কমে গেছে। সরকারি বিনিয়োগও দুর্বল ছিল—এডিপি বাস্তবায়ন হার মাত্র ৬৯%, স্বাধীনতার পর সর্বনিম্ন।
সালেহউদ্দিন আহমেদ এর ব্যাখ্যা দেন— “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে আস্থা কম ছিল। সামনে নির্বাচন থাকায় ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই অপেক্ষায় ছিল। এছাড়া কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট ও ঋণ দেওয়ার অক্ষমতা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করেছে।”
ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠনে সরকার কাজ শুরু করলেও, এখনো সব ব্যাংক স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ ছিল মূলত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, পরিবর্তনমূলক সংস্কার নয়। জাহিদ হোসেন বলেন— “আমরা আশা করেছিলাম একটি স্পষ্ট সংস্কার রোডম্যাপ—কত ব্যাংক একীভূত হবে, জ্বালানি খাতে কী হবে, রাজস্ব সংস্কারের ধাপ কী—এসব নির্দিষ্ট সময়সীমাসহ ঘোষিত হবে। তা হয়নি।”
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক ক্যালেন্ডার যত এগোবে, কঠিন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তত সঙ্কুচিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত অর্থনীতিকে পূর্ণাঙ্গ সংকটের দ্বারপ্রান্ত থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও, এই স্থিতিশীলতা নাজুক। রাজস্ব সংকট, দুর্বল বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং খাতের অমীমাংসিত সমস্যা ভবিষ্যতে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা নিজের কাজের গতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন— “নীতিনির্ধারণ কোনো সহজ কাজ নয়। বাজেট অনেকটা বেলুনের মতো—একপাশে চাপ দিলে অন্যপাশ ফুলে ওঠে। সমন্বয় সবসময়ই কঠিন।”
এখন দেখার বিষয়, নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকার কি না কাঠামোগত সংস্কারের পথে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারে, নাকি এই দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের হাতে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ