
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করদাতাদের সুবিধার জন্য অনলাইন রিটার্ন বা ই-রিটার্নের ব্যবস্থা চালু করেছে। ঘরে বসে বা বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা যায়। তবে এই সুবিধার সুযোগ নিয়ে অনেক করদাতা তাদের সম্পদ, ব্যাংকে থাকা এফডিআর, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়িসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রিটার্নে দেখাচ্ছেন না। ফলে ‘জিরো রিটার্ন’ নামক একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রথা চালু হয়েছে, যেখানে করদাতারা তাদের আয়কর রিটার্নে সব তথ্য ‘শূন্য’ বা ‘জিরো’ দেখিয়ে দিচ্ছেন।
সম্প্রতি এই ‘জিরো রিটার্ন’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান এসব বিষয় নিয়ে শনিবার (৯ আগস্ট) আইসিএমএবি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিস্তারিত মন্তব্য করেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আয়কর আইনে ‘জিরো রিটার্ন’ বা ‘শূন্য রিটার্ন’ নামে কোনো ধারা বা বিধান নেই। করদাতাদের কর ফাঁকি থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করে তিনি বলেন, যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিটার্ন দাখিল করবে, তাদের বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের জেলসহ কঠোর শাস্তি আরোপ করা হবে। এনবিআর শিগগিরই এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করবে।
চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘গত কিছুদিন ধরে শুনেছি অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে একটি নতুন কনসেপ্ট ‘জিরো রিটার্ন’ এসেছে, যেখানে সবাই সব জায়গায় ‘জিরো’ ফিলাপ করে দিচ্ছে। এটা এক্সট্রিমলি ডেঞ্জারাস।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের আয়কর আইনে এই ধরনের কোনো কনসেপ্ট নেই। করদাতা যখন যেকোনো তথ্য দাখিল করেন, সেটাই তার বক্তব্য। যদি তা মিথ্যা হয়, তাহলে পাঁচ বছরের জেলসহ কঠোর শাস্তি রয়েছে।’
চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘আমাদের এনফোর্সমেন্ট অনেক দুর্বল, অথচ আইনগুলো কঠোর। যেমন আমেরিকার জেলে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কর ফাঁকির কারণে থাকে, কারণ সেখানে প্রমাণ করা খুব সহজ। আপনার ব্যাংকে এফডিআর আছে, রেভিনিউ অফিসার আদালতে সেটাই বলল, আপনি জিরো রিটার্ন দিয়েছেন, তাহলে সেটা মিথ্যা হল। এ জন্য পাঁচ বছরের জেলের বিধান রয়েছে।’
এনবিআরের চেয়ারম্যান সবাইকে অনুরোধ করেন, ‘আপনারা আপনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বন্ধুরা সবাইকে জানাবেন যে, দোকানে বসে ‘জিরো রিটার্ন’ দেওয়া যায় এমন কোনো নিয়ম নেই এবং এটি একেবারেই বিপজ্জনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি আপনার ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড অন্য কাউকে দিয়ে দেন এবং পরে বলেন আমি দেয়নি, সেটা আর কোনো প্রমাণযোগ্য যুক্তি হবে না। পেপার রিটার্ন বা অনলাইন যেখানেই হোক, যা আপনি দিচ্ছেন তা সত্য কিনা সেটাই জরুরি।’
চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের রাজস্ব আদায় কম। আমরা সবাই মিলে কাজ করেও রাজস্ব বেস বাড়াতে পারিনি। কর দেয়া থেকে কেউ দরিদ্র হয় না, বরং পেনাল্টি ও জরিমানায় অনেকেই দেউলিয়া হয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘অনেকে ব্যবসা করেন, কিন্তু কখনো জানতে পারেন না তার এমপ্লয়ীরা বড় ধরনের মিসফাইডিং করেছে। পেনাল্টি এমন হলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা চাই ব্যবসা গ্রো করুক, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম থেকেও কর আদায় সম্ভব হয়।’
তিনি স্বীকার করেন, ‘বড় আকারের ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়ে অনেককেই ধরতে পারিনি, তবে গোয়েন্দারা কঠোর পরিশ্রম করছেন এবং যেসব ফাঁকি উদঘাটন করা হয়েছে তা আদায়ও করা হচ্ছে।’ তিনি আশ্বাস দেন, ভবিষ্যতে এনবিআরের আরো কঠোর ও কার্যকর এনফোর্সমেন্টের সাক্ষী হতে হবে।
এনবিআরের চেয়ারম্যানের বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয়, যারা অনলাইনে ‘জিরো রিটার্ন’ দাখিল করছেন বা কর ফাঁকির মাধ্যমে সত্য লুকানোর চেষ্টা করছেন, তারা আইনের আওতায় আসবেন এবং প্রয়োজনে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে।
কর ফাঁকি দমন ও রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য এনবিআর একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করবে, যাতে করদাতাদের ‘জিরো রিটার্ন’ এর বিপদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে। এনবিআর আরও বলেছে, করদাতাদের নিজেদের আয়-সম্পদ যথাযথভাবে প্রদর্শন করতে হবে এবং ভুল তথ্য দিলে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদি শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
বর্তমান যুগে যেখানে অনলাইন সুবিধার মাধ্যমে কর রিটার্ন দাখিল সহজলভ্য, সেখানে করদাতাদের সততা ও দায়িত্বশীলতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এনবিআরের সজাগ নজরদারির মাধ্যমে কর ফাঁকি রোধ ও করদাতাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এনবিআরের আহ্বান, করদাতারা যেন সততা ও আইন মেনে চলেন, আর যারা এ পথ অবলম্বন করেন না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে ‘জিরো রিটার্ন’ বা অন্য কোনো মিথ্যা তথ্য দাখিল করাকে মেনে নেওয়া হবে না, কারণ এটি দেশের আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
বাংলাবার্তা/এসজে