
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর এক নতুন সমীকরণ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের রপ্তানিকারকদের জন্য যেমন কিছু সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনি কিছু নতুন চ্যালেঞ্জও উপস্থাপন করেছে। ২০২৪ সালের শেষে কার্যকর হওয়া এই নতুন শুল্ক কাঠামোর আলোকে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অবস্থান, সুবিধা ও ঝুঁকি নিয়ে বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামত তুলে ধরা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনার পর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বিদ্যমান ১৬.৫ শতাংশ আমদানি শুল্কের সঙ্গে যোগ হলে মোট কার্যকর শুল্ক হার দাঁড়ায় ৩৬.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের ওপর এই হার অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে সংগ্রামরত দেশগুলোর চেয়ে এই হার বাংলাদেশের জন্য একটি সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে ভিয়েতনাম, ভারত ও চীনের কার্যকর শুল্ক হার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি বা তার বেশি, সেখানে বাংলাদেশ ৩৬.৫ শতাংশ হার নিয়ে তুলনামূলকভাবে সস্তায় মার্কিন বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারছে।
২০২৪ সালে মার্কিন পোশাক আমদানি বাজারে বাংলাদেশের বাজার অংশ ছিল প্রায় ৯.৩ শতাংশ। শুল্ক কাঠামোর এই পরিবর্তনের ফলে অনেক বিশ্লেষক আশা করছেন, বাংলাদেশ আরও শক্ত অবস্থান দখল করতে পারবে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, "শুল্ক হার কম হওয়ায় আমাদের পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা বাড়বে। মার্কিন ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা তুলনামূলক কম শুল্কের জন্য বাংলাদেশকে বেশি বেছে নেবেন।"
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, "স্থানীয় সরবরাহকারীকে সচেতন থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা শুল্ক বোঝা বহনের জন্য তাদের ওপর চাপ দিতে পারে, যা মুনাফা সংকোচনের কারণ হতে পারে।"
বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলো মার্কিন বাজারে নতুন শুল্ক হার বহন করছে অনেক ভারী বোঝা।
ভিয়েতনাম: মার্কিন বাজারে ১৮.৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এই দেশটি সিনথেটিক পোশাক রপ্তানিতে বেশি নির্ভরশীল। তাদের কার্যকর শুল্ক হার পৌঁছতে পারে ৫০ শতাংশেরও ওপরে। এছাড়া চীনের ওপর নির্ভরতার কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের ৪০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্কের ঝুঁকি ভোগ করতে হচ্ছে।
ভারত: যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্কসহ ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক প্রযোজ্য হওয়ায় কার্যকর শুল্ক হার দাঁড়িয়েছে ৬৬.৫ শতাংশে, যা ভারতের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
চীন: ২০.৮ শতাংশ মার্কেট শেয়ার থাকা সত্ত্বেও তাদের কার্যকর শুল্ক হার এখন প্রায় ৫৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিশাল শুল্ক পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশের পণ্যের জন্য মার্কিন বাজারে প্রবেশ ও প্রতিযোগিতার সুযোগ অনেক বেশি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বাজারে সুবিধার অন্যতম প্রধান কারণ হলো পোশাক শিল্পে তুলার আধিক্য। মার্কিন শুল্ক নীতিমালা তুলামুখী পণ্যের ওপর কম শুল্ক আরোপ করে।
বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ট্রাউজার, নিটেড পোলো শার্ট, ওভেন শার্ট, সোয়েটার এবং অন্তর্বাস প্রধান, যেগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশই তুলা ব্যবহার করে তৈরি। তাই বাংলাদেশ তুলা ভিত্তিক পোশাক রপ্তানিতে অন্য দেশের তুলনায় শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, যেসব পণ্যে ২০ শতাংশ বা তার বেশি মার্কিন তুলা ব্যবহৃত হয়, তাদের ওই অংশের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক মওকুফ করা হয়। কিছু বাংলাদেশি রপ্তানিকারক ইতোমধ্যে তাদের পণ্যে ৪০ শতাংশ মার্কিন তুলা ব্যবহার শুরু করেছে, যা শুল্ক বোঝাকে আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ মন্তব্য করেন, "৩৬.৫ শতাংশ শুল্ক হার আমাদের জন্য তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা এই অতিরিক্ত শুল্কের কিছু অংশ বহন করতে চাইছেন, যা আমাদের মুনাফাকে প্রভাবিত করতে পারে।"
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি বাজার সংকুচিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে যেখানে আমদানির পরিমাণ ছিল ১০৫ বিলিয়ন ডলার, তা এখন ৮৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, নতুন শুল্ক হার কার্যকর হলে ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে যেতে পারে। এই বাজার সংকোচন বাংলাদেশসহ সব রপ্তানিকারকের জন্য উদ্বেগজনক।"
নতুন শুল্ক সুবিধা থাকলেও মার্কিন বাজার সংকুচিত হওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে। মার্কিন বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে, যা ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করবে এবং খুচরা বিক্রেতারা ক্রয় কমিয়ে দেবে।
এর ফলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি কমে যাবে। অতিরিক্ত পণ্য ইউরোপের বাজারে যেতে পারে, কিন্তু সেখানে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে মূল্যহ্রাস ও কঠিন প্রতিযোগিতা দেখা দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ৮.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, আমদানি করে ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
কম শুল্ক হার পেতে বাংলাদেশকে মার্কিন কৃষিপণ্য, যেমন গম, সয়াবিন, তুলা, উড়োজাহাজ ইত্যাদি বেশি পরিমাণে কিনতে হবে। এছাড়া মার্কিন দুগ্ধ, মাংস ও পোলট্রি শিল্পের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার খুলতে হয়েছে, যা দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জস্বরূপ।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, "মার্কিন বাজারে আমাদের পণ্যের জন্য সুবিধাজনক শুল্ক হার আমাদের রপ্তানি বাড়াবে। পোশাক ছাড়াও জুতা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।"
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, "আমাদের শিল্প খাতের জন্য মার্কিন বাজারে চীনের ওপর নির্ভরতা কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।"
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতি বিশ্ব বাণিজ্যের একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে, যেখানে বাংলাদেশ তুলনামূলক সুবিধা পেলেও বাজারের সংকোচন, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপ ও বাণিজ্যিক শর্তাবলী দেশটির রপ্তানিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করবে।
বিশেষজ্ঞরা একমত, শুধুমাত্র শুল্ক হার কম থাকলেই বাংলাদেশের রপ্তানি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে না; অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দক্ষতা, সরবরাহ শৃঙ্খলা শক্তিশালীকরণ এবং বৈশ্বিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাও অপরিহার্য।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান সংক্ষেপে বলেন, "আমরা সুযোগ নিতে প্রস্তুত। তবে ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সচেতন ও সাবধান থাকতে হবে যাতে সুবিধা হারানোর কোনও সুযোগ না থাকে।"
বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে এই নতুন শুল্ক পরিবেশ সামলানো এক ধরনের “নাজুক পথ” যা দক্ষ পরিকল্পনা ও সঠিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সহজ হবে না। ভবিষ্যতের বাজারে টিকে থাকতে হলে দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, কাঁচামালের বৈচিত্র্যকরণ ও মার্কেট এক্সপোর্ট পোর্টফোলিও বিস্তৃত করতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ