
ছবি: সংগৃহীত
গাজার মাটিতে চলছে এক ভয়ংকর খেলা—যার নাম দেওয়া যেতে পারে “মৃত্যুর ত্রাণ প্রতিযোগিতা”। ক্ষুধা ও অনাহারে ক্লান্ত মানুষদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে প্রাণের ঝুঁকি, ঠিক যেন জনপ্রিয় কোরিয়ান ওয়েব সিরিজ স্কুইড গেম-এর বাস্তব রূপ। পার্থক্য শুধু একটাই—সিরিজে প্রতিযোগীরা আগে থেকেই জানতেন তাদের ঝুঁকি, কিন্তু গাজায় অংশগ্রহণকারীরা বাধ্য হচ্ছেন অলিখিত মৃত্যুর খেলায় নামতে, যেখানে নিয়মের কোনো পূর্বঘোষণা নেই, আর সতর্কবার্তাহীন মুহূর্তেই চলে আসছে স্নাইপারের গুলি।
গাজার ছোট্ট শিশু আহমেদ জিদানের গল্প এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতীক। ভোরে তার মা ত্রাণ সংগ্রহে গিয়েছিলেন, যেন ছেলের জন্য কিছু খাবার নিয়ে ফিরতে পারেন। কিন্তু ফিরে এলেন নিথর দেহ হয়ে। ধুলো মাখা মুখে, কাঁপা হাত-পা নিয়ে জিদান বসে আছে মাটিতে, চোখে অসহায় জল। গাজার অনেক শিশুর জীবন আজ এমনই—ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর ফাঁদে পা দেওয়ার সমান।
মে মাসের শেষ দিক থেকে অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ বিতরণের নামে নতুন এক মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান “গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন” (জিএইচএফ)। ইসরাইলি সেনাদের পাহারায় পরিচালিত এই কেন্দ্রগুলো কার্যত পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের জন্য মৃত্যুর ময়দানে।
গাজায় শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়া একেবারে স্কুইড গেম-এর প্রথম ধাপ “রেড লাইট, গ্রিন লাইট”-এর মতো। সেখানে সেন্সরযুক্ত পুতুলের বদলে আছে ইসরাইলি স্নাইপার। খেলায় যেমন সময়মতো পৌঁছাতে না পারলেই মৃত্যু নিশ্চিত ছিল, তেমনি গাজার এই ত্রাণকেন্দ্রে দেরি হলে বা ভুল পদক্ষেপ নিলেই গুলি এসে বিঁধছে দেহে।
১৭ জুন, মধ্যরাতে জিএইচএফ ঘোষণা দেয় যে খান ইউনিসে তাদের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র সকাল ৬টায় খোলা হবে। তারেক আল-বোরাইম নামের এক ফিলিস্তিনি তখনই বুঝে গিয়েছিলেন এই খেলায় সময়ের গুরুত্ব কতটা ভয়ংকর। তিনি বন্ধু-স্বজনদের সতর্ক করেছিলেন—ঘোষিত সময়ের আগে গেটে যেও না, কারণ ইসরাইলি সেনারা সময়ের আগেই গেট খুলে কিছু সময় পর তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বাস্তবতা ছিল আরও ভয়ংকর।
সেদিন রাত ১টা ৪৭ মিনিটেই কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়, কয়েক মিনিট পর গেট বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষুধার্ত মানুষ তখনো ভিড় করে অপেক্ষা করছিল, কেউবা ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। আর সেই মুহূর্তে শুরু হয় গুলি—সেদিন অন্তত ৫৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
গাজার সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, মে মাসের শেষ থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর ত্রাণ সংগ্রহের সময় ইসরাইলি গুলিতে ৫৮৪ জন নিহত এবং ৪,০০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। শুধুমাত্র ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে—অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১,৬৫৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১১,৮০০ জন আহত হয়েছেন।
বেইত লাহিয়ার বাসিন্দা সামেহ এখন আশ্রয়হীন হয়ে আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন। তার ভাষায়— “শত দিনের বেশি আমরা না খেয়ে আছি। তারা একটুও খাবার ঢুকতে দেয়নি। তারপর খুলেছে তথাকথিত আমেরিকান সাহায্য কেন্দ্র, যা ইসরাইলি সৈন্যদের পাহারায় চলছে। এটা খাবার নয়, এটা ফাঁদ।”
ওয়াদি নামের আরেক ফিলিস্তিনি নেটজারিমে ত্রাণ আনতে গিয়ে দেখেন এক ধরনের “খেলাঘর”—চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া, ভেতরে সহায়তা সামগ্রী, কিন্তু খোলার সময়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখনো ভোরে, কখনো গভীর রাতে হঠাৎ গেট খুলে দেওয়া হয়। হাজারো মানুষ তীব্র গরমে দাঁড়িয়ে থাকে, গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে, মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যায়—এর মাঝেই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, আর গুলির শব্দে ভরে ওঠে আকাশ।
সামেহ বিশ্বাস করেন, এই কেন্দ্রগুলো ইসরাইলের কৌশলেরই অংশ। তার ভাষায়— “তারা বিশৃঙ্খলা চায়, আতঙ্ক চায়। এই কেন্দ্রগুলো শুধু দেখানোর জন্য যেন গাজায় সাহায্য আসছে। কিন্তু কী লাভ, যদি সেই সাহায্য আমাদের কাছে না পৌঁছায়? যদি জীবন বাজি রেখে এক ব্যাগ ময়দা পেতে হয়—এটা কেমন সাহায্য?”
স্কুইড গেমে যেমন ধনীরা প্রতিযোগীদের মৃত্যু দেখে বিনোদন পেত, গাজাতেও অনেক রাষ্ট্র পরোক্ষভাবে সেই ভূমিকা পালন করছে। ইসরাইলকে অর্থ ও সামরিক সহায়তা দিয়ে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে, তারা এই মৃত্যুমিছিলের নীরব দর্শক হয়ে আছে। ফলে গাজার প্রতিটি ত্রাণকেন্দ্র এখন যেন মানবতার জন্য কলঙ্ক, আর বাসিন্দাদের জন্য প্রাণবাজির মঞ্চ।
যুদ্ধের এই অবরুদ্ধ প্রান্তরে এখন প্রতিদিন চলছে জীবন ও মৃত্যুর লড়াই, যেখানে ক্ষুধা, আতঙ্ক ও গুলি মিলে গড়ে তুলেছে এক নির্মম খেলা—যার নাম দিয়েছে অনেকেই গাজার স্কুইড গেম।
বাংলাবার্তা/এমএইচ