
ছবি: সংগৃহীত
চিরকাল তেতো স্বাদের জন্য পরিচিত হলেও, চিরতা (আয়ুর্বেদিক নাম: কিরাততিক্তা) আসলে এক অসাধারণ ভেষজ গাছ, যার স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে স্বীকৃত। বাংলায় একে “চিরকাল তিতা” থেকে সংক্ষেপে “চিরতা” বলা হয়ে থাকে। অনেকেই এর চেহারা দেখে একে কালমেঘের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, কিন্তু দুইটি উদ্ভিদ ভিন্ন। চিরতা আয়ুর্বেদ, ইউনানি ও প্রাচীন দেশি চিকিৎসায় বহু রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে খালি পেটে সকালে এর পানি পান করলে শরীরের ভেতরকার বিভিন্ন সমস্যা দূর করার পাশাপাশি সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়।
চিরতার গুণাগুণ শুধু লোকমুখেই প্রচলিত নয়, বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও এর বিভিন্ন কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। এই গাছের মূল, পাতা ও কান্ডে এমন সব প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে যা শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তকে পরিশুদ্ধ করে এবং হজমশক্তি উন্নত করে।
এবার চলুন একে একে দেখে নেওয়া যাক, নিয়মিত খালি পেটে চিরতার পানি খেলে কী কী অসাধারণ উপকার পাওয়া যায়—
১. ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে কার্যকর
চিরতার অন্যতম প্রধান গুণ হলো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমানো। এর প্রাকৃতিক রাসায়নিক উপাদান ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে ব্লাড সুগার লেভেলকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক ওষুধের মতো কাজ করে। পাশাপাশি, চিরতার পানি রক্তে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল (LDL) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।
২. অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
মৌসুমি অ্যালার্জি, ধুলোবালি বা খাবারে অ্যালার্জির কারণে অনেকের শরীরে চুলকানি, ফোলাভাব, চোখ লাল হয়ে যাওয়া বা র্যাশ হয়। চিরতার পানি শরীরে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা এসব উপসর্গ দ্রুত উপশম করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করলে অ্যালার্জির প্রবণতা কমে আসতে পারে।
৩. লিভারের জন্য প্রাকৃতিক টনিক
বর্তমান সময়ে ফ্যাটি লিভার, লিভার এনজাইমের ভারসাম্যহীনতা বা হেপাটাইটিসের মতো সমস্যা বাড়ছে। চিরতার পানি লিভার পরিষ্কার রাখে, জমে থাকা চর্বি ভেঙে দেয় এবং লিভারের কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে। এটি লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
৪. শরীর থেকে টক্সিন দূরীকরণ
চিরতা এক ধরনের প্রাকৃতিক ডিটক্সিফায়ার। এটি রক্ত ও কোষ থেকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক এবং টক্সিন বের করে দেয়, ফলে শরীর ভেতর থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়। এর ফলে শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় না, মানসিকভাবেও সতেজ অনুভূতি আসে।
৫. হজমশক্তি বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ
যাদের অ্যাসিডিটি, গ্যাস বা বদহজমের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য চিরতার পানি দারুণ কার্যকর। এটি হজম এনজাইম সক্রিয় করে খাবার দ্রুত ভাঙতে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্যের ক্ষেত্রে এটি অন্ত্রের গতিশীলতা বাড়িয়ে মলত্যাগ স্বাভাবিক করে।
৬. অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক
শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত না থাকলে অ্যানিমিয়া দেখা দেয়, যার ফলে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা হতে পারে। চিরতার পানিতে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান রক্ত উৎপাদনে সহায়তা করে এবং শরীরে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়।
৭. ত্বকের সমস্যায় প্রাকৃতিক সমাধান
চামড়ার ঘা, একজিমা, ব্রণ বা ফাঙ্গাল ইনফেকশনের মতো ত্বকের নানা সমস্যায় চিরতার পানি ভেতর থেকে কাজ করে। এর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান ত্বকের ক্ষত দ্রুত সারাতে এবং ত্বক উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে।
৮. তারুণ্য ধরে রাখায় সহায়ক
চিরতার পানি রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে কোষে অক্সিজেন সরবরাহ উন্নত করে। ফলে ত্বকে কোলাজেন উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, বলিরেখা দেরিতে আসে এবং ত্বক থাকে টানটান ও সতেজ। এটি এক প্রাকৃতিক এন্টি-এজিং পানীয় হিসেবে কাজ করতে পারে।
৯. মৌসুমি রোগ প্রতিরোধে কার্যকর
ঋতু পরিবর্তনের সময় অনেকের সর্দি-কাশি, হাঁচি, বমি বমি ভাব, এমনকি জ্বর হয়। চিরতার পানি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে এসব সমস্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে। হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্যও এটি উপকারী।
১০. কৃমিনাশক গুণ
চিরতা প্রাকৃতিক কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে পেটের কৃমি দূর করতে এটি নিরাপদ ও কার্যকর একটি উপায়।
চিরতার পানি তৈরির পদ্ধতি
শুকনো চিরতা ছোট ছোট টুকরো করে পরিষ্কার পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে সেই পানি ছেঁকে খালি পেটে পান করতে হবে। নিয়মিত অভ্যাস করলে ধীরে ধীরে শরীরে এর ইতিবাচক প্রভাব অনুভব করা যাবে।
সতর্কতা
চিরতার পানি অত্যধিক তিতা হওয়ায় অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে বমি, মাথা ঘোরা বা রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। তাই চিকিৎসক বা আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাচীন ভেষজ চিকিৎসায় চিরতা এক অনন্য উপাদান, যা আধুনিক জীবনযাত্রার নানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। নিয়মিত ও পরিমিত মাত্রায় খালি পেটে চিরতার পানি পান করা স্বাস্থ্য রক্ষার এক সহজ কিন্তু কার্যকর উপায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ