
ছবি: সংগৃহীত
গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের জায়গায় গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের চাকরির বাজারে আশাব্যঞ্জক কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। মূলত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রত্যাশায় যে গণআন্দোলন হয়েছিল, তার দাবিগুলো এখনও পূরণ হয়নি। সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি সীমিত থাকায় প্রতিযোগিতার চাপ আগের মতোই তীব্র, এবং হাজারো স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারীদের জন্য উপযুক্ত চাকরির সুযোগ তৈরি হয়নি।
অর্থনৈতিক তথ্য ও ব্যাংক ঋণ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, নতুন কোনো শিল্প ইউনিট চালু হয়নি, বরং অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থা চাকরির বাজারেও প্রভাব ফেলেছে, কারণ উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় কারখানায় চাকরির বিজ্ঞপ্তি অনেকাংশেই কমে গেছে।
তাছাড়া, বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যাও আগের বছরের তুলনায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে। সীমিত অর্থায়ন এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা চাপে পড়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দুর্বল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দেয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর আর্থিক নীতিমালা গ্রহণ করেছে, যার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ পাওয়া আরও কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাব বিনিয়োগে পড়েছে, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে বাধা দিয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক মাসে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগ বাড়াতে পারেননি। পরবর্তীতে সরকারের মূল মনোযোগ ছিল দামের নিয়ন্ত্রণে, যা বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
চাকরির বাজারে সমস্যার এক বড় কারণ হল দক্ষতা ও চাহিদার মধ্যে ফারাক। সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিক থেকে স্পষ্ট কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা বাজারের চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সেলিম রায়হান সাম্প্রতিক এক জরিপ উদ্ধৃত করে বলেন, ‘৫০ শতাংশের বেশি চাকরিপ্রার্থী সাক্ষাৎকারের জন্যও ডাক পাননি।’ তিনি বেসরকারি খাতের স্থবিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার খারাপ অবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, শিল্পখাতে শ্রমিকের সংখ্যা ২০১৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত কমেছে প্রায় এক লাখ। মোট কর্মসংস্থানও ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে প্রায় ৩ শতাংশ কমে ছয় কোটি ৯১ লাখে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে প্রবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ায় দেশীয় বেকারত্বের চাপ বেড়েছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) জানায়, গত বছর বিদেশে কাজ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমেছে।
সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের জন্য যুবঋণের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি যুবতীদের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিলও গঠন করেছে। তিন বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ খাতে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
এছাড়া, ২০২৮ সালের মধ্যে নয় লাখ তরুণকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪৮টি জেলায় প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষিত বেকারের জন্য ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।
গত মে মাসে জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ দক্ষ কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, যা দেশে কর্মসংস্থানের জন্য এক ইতিবাচক সঙ্কেত।
শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে শ্রম অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। তবে কমিশন প্রধানের মতে, কার্যকর বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন এবং নিয়োগকর্তাদের চাহিদা বোঝার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক কর্মসংস্থান গবেষণা বিভাগ প্রয়োজন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, শ্রম মন্ত্রণালয়ে এখনও কর্মসংস্থান শাখা নেই। তিনি শাখা গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন, তবে আমলাতান্ত্রিক বাধায় তার মেয়াদে কাজ সম্পন্ন নাও হতে পারে।
তিনি চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেন এবং বলেন, ‘এটা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের অংশ, যা পরবর্তী সরকারের দায়িত্ব।’
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে এখনো সংকোচে রয়েছেন। দক্ষতার অভাব ও শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যার কারণে তরুণদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ সীমিত হচ্ছে।
অর্থাৎ, দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকর নীতি ও উদ্যোগ নিতে হবে, যা বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখবে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ