
ছবি: সংগৃহীত
তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ সোমবার (১১ আগস্ট) মালয়েশিয়া যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফরটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে, যা মূলত তাঁর গত বছরের বাংলাদেশ সফরের প্রতিদান হিসেবে দেখা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে আনোয়ার ইব্রাহিম ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে ঢাকা সফর করেছিলেন, যেখানে দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে একাধিক আলোচনা হয়েছিল। এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বৈঠকে সেই আলোচনার অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সফরকালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, জ্বালানি খাতের যৌথ উদ্যোগ, শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ বাড়ানো এবং প্রযুক্তি বিনিময় নিয়ে গভীর আলোচনা হবে। এর পাশাপাশি, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় করতে একটি যৌথ ব্যবসায়িক কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরিকল্পনাও রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই সাক্ষাৎ শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়ের সুযোগ হতে পারে। মাহাথির, যিনি দুই দফা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারণে অনুপ্রেরণাদায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী দলে রয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত। এই উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সফরের গুরুত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টার উপস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে। বর্তমানে মালয়েশিয়া বাংলাদেশি শ্রমশক্তির অন্যতম বড় গন্তব্য, যেখানে কয়েক লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখছেন। শ্রমবাজারে নতুন সুযোগ সৃষ্টি এবং বিদ্যমান শ্রমিক সমস্যার সমাধান এই সফরের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হতে পারে।
এছাড়া, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হবে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প গ্রহণ এবং এলএনজি আমদানির বিষয়ে সমঝোতা হতে পারে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও দুটি দেশ প্রশিক্ষণ বিনিময়, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং যৌথ মহড়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় বসতে পারে।
মালয়েশিয়া সফরের সময় মোট পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১. প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি
২. জ্বালানি খাতে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি
৩. যৌথ ব্যবসায়িক কাউন্সিল গঠন
৪. প্রবাসী শ্রমবাজার সম্প্রসারণ চুক্তি
৫. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে সহযোগিতা চুক্তি
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি প্রভাবশালী অর্থনীতি, আর বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণও ক্রমেই বাড়ছে। ফলে, এই সফরকে কেবল একটি আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে দেখা যাবে না; বরং এটি হতে পারে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সফর থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক বড়—প্রবাসী কল্যাণ, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি সহযোগিতার মতো খাতে নতুন সুযোগ উন্মোচনই এই সফরের মূল লক্ষ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সফর সফলভাবে সম্পন্ন হলে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ