
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো—যেখানে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে এক আসামি সম্পূর্ণ নির্দোষ হিসেবে খালাস পেলেন।
মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল ১১টার দিকে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ এই বহুল আলোচিত রায় ঘোষণা করেন। দীর্ঘ প্রায় এক দশকের আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে এটিএম আজহারুল ইসলাম নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। বিচারপতিরা রায়ে উল্লেখ করেন যে, মামলার প্রমাণপত্র, সাক্ষ্য এবং যুক্তি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। তাই তাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ খালাস দেওয়া হলো।
এই রায়ের ফলে জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের মুক্তিতে আর কোনো আইনি বাধা নেই বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা। আদালতের রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, “এই রায়ের জন্য প্রথমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। আজহারুল ইসলামকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। এটি ছিল বিচার প্রক্রিয়ার নামে অবিচার, আর সেই অবিচার আজকে শেষ হলো।”
তিনি আরও বলেন, “এই রায়ের মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর বিচার ইতিহাসেও এক বিরল ঘটনা। এমন অন্যায়ভাবে একটি মানুষকে দীর্ঘ ১২ বছর কারাগারে বন্দী রাখা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটিএম আজহারের ওপর যে ধরনের নির্যাতন হয়েছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন থেকে যাবে।”
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট তার মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারকরা আজহারকে ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেন। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার মতো গুরুতর অপরাধ। বিশেষ করে বদর বাহিনীর নেতৃত্বে তিনি স্থানীয় হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছেন বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ ছিল।
এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এরপর ২০২০ সালের ১৫ মার্চ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর একই বছরের ১৯ জুলাই এটিএম আজহারুল ইসলামের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন করা হয়। এটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ রিভিউ শুনানি। এমনকি পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে আদালত পুনরায় আপিল শুনানির অনুমতি দেন, যা এই ধরনের মামলার জন্য নজিরবিহীন ঘটনা।
এতদিন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে কেউই আপিল বিভাগে গিয়ে সম্পূর্ণ খালাস পাননি। এই প্রথমবার কোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ আদালত বেকসুর খালাস দিলেন, যা বাংলাদেশের আইন ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গ্রেপ্তারের পর থেকে গত ১২ বছর ধরে এটিএম আজহারুল ইসলাম কারাগারে বন্দী ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি সব ধরনের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন বলে জানিয়েছেন তার পরিবার ও আইনজীবীরা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই রায় শুধুমাত্র একজন নির্দোষ মানুষকে মুক্ত করলো না, বরং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তাও পৌঁছে দিল।
জামায়াতে ইসলামী এই রায়কে ‘ন্যায়বিচারের বিজয়’ হিসেবে অভিহিত করেছে। এক বিবৃতিতে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, “ফ্যাসিবাদী সরকারের সাজানো মামলায় আমাদের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছিল। আজকের এই রায় প্রমাণ করে যে, তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলেন। এটিএম আজহারের খালাস প্রমাণ করে যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এখনো সম্ভব।”
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার এই রায় নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু একটি মামলার সমাপ্তি নয়, বরং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি আদালতের অঙ্গীকারের এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত। এখন দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, এটিএম আজহারুল ইসলাম কবে কারামুক্ত হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন—সেই মুহূর্তটির জন্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ