
ছবি: সংগৃহীত
জাতির ইতিহাসে কালিমালিপ্ত অধ্যায় ২০২৪ সালের জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নির্দেশদাতাদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, এবং এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এদের একটি বড় অংশের বিচার শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক আলোচনায় তিনি এ কথা জানান।
‘জুলাই গণহত্যার বিচার, আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শন’ শীর্ষক এই আয়োজনটি ছিল জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালার একটি অংশ। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারক, প্রসিকিউটর, আইনবিদ, শিক্ষক এবং মানবাধিকার কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব। জাতির গণতন্ত্র, মানবতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতির এই বাস্তব রূপায়নেই আগামী প্রজন্মের জন্য সত্য ও ইতিহাস তুলে ধরা সম্ভব হবে। আমরা আশা করছি, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নির্দেশদাতাদের একটি বড় অংশের বিচার সম্পন্ন করতে পারব।”
তিনি আরও জানান, “এই বিচার হচ্ছে আইন ও প্রমাণের ভিত্তিতে। কারো প্রতি পক্ষপাত নেই, আবার কোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধের উদ্দেশ্যও নেই। এর একমাত্র লক্ষ্য—ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জাতির কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।”
এ সময় চিফ প্রসিকিউটর এক আলোচিত মামলার বিষয়েও আপডেট দেন। তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ হবে আগামী ৩ আগস্ট। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা, যেখানে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পেছনের গভীর প্রেক্ষাপট উন্মোচিত হবে।”
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে, যা নিয়ে চলমান বিচারিক প্রক্রিয়া দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।
অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সুপরিচিত মানবাধিকার কর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা কীভাবে বিদেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো, সেটাও বিচার হওয়ার দাবি রাখে। কারণ এই পলায়নের নেপথ্যে যদি রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক সহযোগিতা থেকে থাকে, তা হলে সেটি আমাদের আইনের প্রতি বিশ্বাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
তিনি আরও বলেন, “এই হত্যাকারীদের সমর্থকরা এখনও বিভিন্ন সেক্টরে থেকে গেছে। যদি তারা না থাকত, তাহলে খুনিরা এত সহজে পালিয়ে যেতে পারত না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই গোষ্ঠীকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহের। তিনি বলেন, “জুলাইয়ের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ শুধু কয়েকটি ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় ছিল। এর পেছনের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করাই বর্তমান সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার।”
তিনি আরও বলেন, “আইন মন্ত্রণালয় বিচার বিভাগ, ট্রাইব্যুনাল এবং তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত বিচার সম্পন্নে কাজ করে যাচ্ছে। কোনো বিচার বিলম্বিত হলে তা শুধু ভুক্তভোগীদের নয়, পুরো জাতির কাছেই এক প্রকার অবিচার হিসেবে বিবেচিত হয়।”
অনুষ্ঠানে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত শিক্ষার্থীদের জন্যও শোক প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানের শেষপর্বে ‘ট্রায়াল অব জুলাই কার্নেজ’ শীর্ষক একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়, যেখানে জুলাই অভ্যুত্থান ও গণহত্যার পটভূমি, ঘটনার ক্রম, নিহত ব্যক্তিদের পরিচয়, অভিযুক্তদের পালিয়ে যাওয়া এবং বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি তুলে ধরা হয়।
এই তথ্যচিত্রটি উপস্থিত বিচারক, আইনজীবী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে এবং অনেকে তা ইতিহাস রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ বলে মন্তব্য করেন।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ভয়াবহ অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এক অন্ধকার অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের হত্যা ও ষড়যন্ত্র, প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা মিলিয়ে একটি জাতিগত ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয় এ ঘটনা।
তবে সাম্প্রতিক সময়ের বিচারিক গতি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আশাবাদী অবস্থান এবং জনগণের সচেতন চাপ—সব মিলিয়ে মনে করা হচ্ছে, বহু প্রতীক্ষিত এই বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরই একটি দৃশ্যমান পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। যদি সব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তবে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্দেশদাতাদের একটি বড় অংশ বিচারের কাঠগড়ায় এসে ন্যায়বিচার দেখতে পাবে পুরো জাতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ